সরস্বতী পুজো

সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই কেন? সত্যিই কি পাপ দেন বিদ্যার দেবী? যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই প্রথার পিছনে রয়েছে কোন অজানা রহস্য? সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেলে সত্যিই কি রুষ্ট হন বাগদেবী? এটা কি শুধুই ধর্মীয় কুসংস্কার নাকি রয়েছে কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ?

প্রত্যেক বছর মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বাগদেবীর আরাধনার মেতে ওঠেন সকলে। হাতে গোনা মাত্র আর ক’দিন। তারপরেই  এসে পড়বে বাঙালির প্রিয় উৎসব সরস্বতী পুজো। এবছর ১৪ ই ফেব্রুয়ারিতেই পড়েছে সরস্বতী পুজো। বাঙালিদের কাছে প্রতি বছরই এই দিনটি  অত্যন্ত বিশেষ। সরস্বতী পুজোর আগে বাজার ছেয়ে গিয়েছে টোপা কুল, আপেল কুল, নারকেল কুল, কিংবা টক কুলে। আর সরস্বতী পুজো যত এগিয়ে আসছে, ততই যেন কুলের প্রতি দুর্বলতা বাড়ছে।

সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া নিয়ে  যুগ যুগ ধরেই প্রচলিত রয়েছে একটি প্রথা। পড়ুয়াদের বিশ্বাস সরস্বতী পুজার আগে কুল খেলে নাকি ঠাকুর পাপ দেয় বাগদেবী সরস্বতী। পরীক্ষাতেও আসবে গোল্লা। তাই পুজোর আগে ভুলে  কুল খায় না কেউ। আর কুল ছাড়া বাগদেবীর আরাধনাও  অসম্পূর্ণ। শাস্ত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, কুলের সঙ্গে সরস্বতী পুজোর একটি সম্পর্ক রয়েছে, রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনিও।কিন্তু সত্যিই কি তাই? সরস্বতী পুজোর আগে আমরা কুল খাই না কেন? এটা কি শুধুই কোন ধর্মীয় কুসংস্কার? নাকি এর পেছনে রয়েছে কোন বৈজ্ঞানিক কারণ?

পৌরাণিক কাহিনি

আসলে সরস্বতী পুজোর আগে কুল না খাওয়ার পিছনে রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনীও। পুরান মতে বৈদিক দর্শনবিদ্যা অর্জনের উদ্দেশে দেবী সরস্বতীকে তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব বদ্রিকাশ্রমে তপস্যা করতে বসেছিলেন। কিন্তু তাঁর তপস্যা শুরুর আগেই  তপস্যাস্থলের কাছে একটি কুলের বীজ রেখে দেবী সরস্বতী শর্ত দেন, এই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা এবং তা থেকে বড় গাছ, সেই গাছের ফুল থেকে নতুন কুল হবে। আর সেই কুল পেকে যতদিন না তা ব্যাসদেবের মাথায় পড়বে ততদিন তাঁর তপস্যা পূর্ণ হবে না। এই শর্ত মেনে তপস্যা শুরু করেন ব্যাসদেব।

তখনই প্রসন্ন হবেন দেবী সরস্বতী। দেবীর এই শর্তে রাজি হয়ে ব্যাসদেব তপস্যা শুরু করেন। তপস্যা শুরুর পর ধীরে ধীরে বেশ কয়েক বছরে বীজ থেকে চারাগাছ তার থেকে বড় গাছ হয়ে তা থেকে কুল পেকে যেদিন তা ব্যাসদেবের মাথায় পরে সেদিন তিনি বুঝতে পারেন, বাগদেবী তাঁর তপস্যায় প্রসন্ন হয়েছেন। আর সেই দিনটি ছিল মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথি।

সে দিন বেদমাতা সরস্বতীকে বদ্রী অর্থাৎ কুল ফল নিবেদন করে ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেন মহামুনি ব্যাসদেব। শ্রীপঞ্চমীর দিন  দেবী বীণাপানি তুষ্ট হয়েছিলেন, তাই সেই থেকেই শ্রীপঞ্চমীর দিন দেবী সরস্বতীকে কুল নিবেদন করার পরেই কুল খাওয়া হয়।

সামাজিক কারণ

ভারতবর্ষ  মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। তাই হিন্দু ধর্মে মরসুমের যে কোনো প্রথম ফলই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উত্‍সর্গ করার পরেই তা খাওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে আমাদের মধ্যে। এই কারণেই নতুন ধান উঠলে নবান্ন উত্‍সব পালন করা হয়। তেমনই শীত বসন্তের মাঝামাঝি  এই সময়টায় কুল গাছে প্রথম ফল ধরে। তাই এই ফল আগে দেবী সরস্বতীকে তা নিবেদন করে প্রসাদ হিসেবে খাওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে  হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে।

বৈজ্ঞানিক কারণ

তবে শুধু পৌরাণিক কিংবা সামাজিক কারণই নয় সরস্বতী পুজোর আগে কুল না খাওয়ার এই লোকাচারের পিছনে একটি বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। আসলে সরস্বতী পুজো মানেই  শীতের অবসান ও বসন্তের শুরু। আর সিজন চেঞ্জের সময়ে সর্দি-কাশি কিংবা পেটের সমস্যা লেগেই থাকে। সরস্বতী পুজোর সময়ই কুল পাকতে শুরু করে। তাই তার আগে কাঁচা কুল খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে, তাছাড়া টক কুল খেলে দাঁতের জন্য ক্ষতিকারক। তাই এই সমস্ত  কারণেও সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে বারণ করা হয়।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *