জ্ঞানবাপী মসজিদ

জ্ঞানবাপীর বেসমেন্টে কোন হিন্দু মন্দিরের অজানা রহস্য আছে জানেন? মন্দির ভেঙে মসজিদ হল কীভাবে? আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সমীক্ষায় কীসের প্রমাণ মিলল? জ্ঞানবাপীর বেসমেন্ট থেকে কী কী উদ্ধার করেছে ASI?

আদালতের নির্দেশ মিলতেই উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদের ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পূজা শুরু করেছেন হিন্দুরা। কাকতালীয়ভাবে ৩৮ বছর আগে ১৯৮৬ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারিই অযোধ্যার বাবরি মসজিদের তালা খোলা হয়েছিল।

হিন্দুপক্ষের দাবি ‘ব্যাস কা তহখানা’ দীর্ঘ দিন ধরে ‘ব্যাস’ পুরোহিত বংশের দখলে ছিল। তখন মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন সোমনাথ ব্যাস।  তাঁরা এক সময় ওখানে বসবাসও করতেন। ওই  পুরোহিত বংশেরই পুরোহিত শৈলেন্দ্রকুমার পাঠক ব্যাস আদালতে জানিয়েছেন ১৯৯৩ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মসজিদের এই অংশেই নিয়মিত পুজোপাঠ করতেন হিন্দুরা। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে উত্তেজনা ঠেকাতে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবের সরকার মসজিদের অন্দরে পুজো-পাঠ  বন্ধ করে দিয়েছিল। সেসময়  সিল করে দেওয়া হয় মসজিদের বেসমেন্ট।

তারপর মসজিদ চত্বরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে জ্ঞানবাপী মসজিদ প্রবন্ধন সমিতি অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া মসজিদের ওপর। এবার বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদের ‘সিল’ করা অংশের একাংশে হিন্দু ভক্তদের পুজো করার অনুমতি দিয়েছে বারাণসীর জেলা আদালত। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মঙ্গলবার ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হবে  ভূগর্ভস্থ ওই কক্ষ।

আদালতের রায় ঘোষণা করার আগেই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সমীক্ষায় দেখা যায় জ্ঞানব্যাপী মসজিদের নীচেই রয়েছে হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব। উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে অবস্থিত জ্ঞানব্যাপী মসজিদেই যে সপ্তদশ শতাব্দীর হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে,সেই  দাবি জানিয়ে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছিল। এই মন্দিরের পুরোহিত সোমনাথের উত্তরাধিকারী হিসাবে আবার পুজো করার অনুমতি চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন শৈলেন্দ্র। জেলাশাসককে ওই তহখানার রিসিভার হিসাবে নিয়োগ করার আবেদনও করেন। জ্ঞানবাপীতে পুজো করার অনুমতি চেয়ে স্থানীয় পাঁচ হিন্দু মহিলার তরফেও আদালতে পৃথক আর্জি জানানো হয়েছিল। এরপরই নৃতত্ত্ব সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হলে  ২০২৩ সালে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা হয় জ্ঞানব্যাপী মসজিদে। বৃহস্পতিবারেই প্রকাশ্যে আসে সেই রিপোর্ট।

কী এই ব্যসের তয়খানা?

হিন্দু পক্ষের দাবি, ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসের পর পুরোহিত সোমনাথ ব্যসকে এই চত্বরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। রাতারাতি ব্যারিকেড করে বেসমেন্টের পুজার্চনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। হিন্দু পক্ষের দাবি, বংশ পরম্পরায় তাঁর পরিবার ব্রিটিশ আমল থেকে এখানে পুজো করতেন।

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের রিপোর্ট প্রমাণ করছে জ্ঞানবাপীর অন্দরে এই অংশেই হিন্দু দেবতাদের নিত্য পুজো হত। এই অংশে সার্ভে চলাকালীন কী কী পৌরাণিক সামগ্রী পায় ASI আধকারিকরা?

জ্ঞানবাপীর ASI সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, বাস্তু শিল্পের সঙ্গে জড়িত নানা হিন্দু চিহ্ন, কারুকার্য করা পাথর, শিলালিপির অংশ, আলাদা আলাদা শাস্ত্রের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে এই বেসমেন্টে। পাওয়া গিয়েছে আটটি শিবলিঙ্গ। এ ছাড়াও পাওয়া গিয়েছে মোট ২৫৯টি সামগ্রী। তার মধ্যে রয়েছে দেবদেবীর মূর্তির ভাঙা খণ্ড, শিবলিঙ্গ, শিলালিপি ইত্যাতি। বেসমেন্টের পশ্চিম দিকের দেওয়ালের দিকে ১১৫টি এবং দক্ষিণ দিকের অংশে ৯৫টি বস্তু পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে ৫৫টি হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া আটটি শিবলিঙ্গ, বিষ্ণু প্রতিমা, একটি মকর, একটি শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি, দু’টি গণেশ মূর্তি, দু’টি হনুমান মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। মিলেছে  দু’টি টেরাকোটা প্রতিমা, ৬৬টি ধাতু মূর্তির অংশ ।

আদালতের নির্দেশে ২০২২ সাল থেকে মসজিদের ওজুখানা ‘সিল’ করে রাখা হয়েছিল। হিন্দু পক্ষের দাবি ‘স্বয়ম্ভূ জ্যোতির্লিঙ্গ ভগবান বিশ্বেশ্বর’ নামে পরিচিত ওই অংশেই প্রাচীন শিবলিঙ্গ মিলেছে। যদিও  মসজিদ কমিটির দাবি, সেটি আদতে ফোয়ারা। সোমবারই হিন্দুদের তরফে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে, ওই শিবলিঙ্গের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হোক এবং যেখানে সেটি পাওয়া গিয়েছে, সেখানে প্রত্নখননের অনুমতি দেওয়া হোক। যদিও মুসলিম পক্ষের পাল্টা দাবি, মসজিদ চত্বরে সমীক্ষার দাবি, ১৯৯১ সালের ‘ধর্মীয় উপাসনাস্থল রক্ষা (বিশেষ ব্যবস্থা) আইন’-এর পরিপন্থী।

এমনকি মুসলিম পক্ষের  দাবি, যে ভূগর্ভস্থ কক্ষটিতে হিন্দুরা পূজা করার অনুমতি চাইছেন, সেখানে ব্যাস নামের কোনও পরিবারের সদস্য কখনওই পূজা করতেন না। তাই ভূগর্ভস্থ কক্ষটিতে ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর থেকে পূজা বন্ধ হয়ে গেছে, এই প্রশ্নটাই অবান্তর।

অন্যদিকে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ প্রসঙ্গে অযোধ্যার রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের কোষাধ্যক্ষ গোবিন্দ দেব গিরি মহারাজ দাবি তুলেছেন, বারাণসী ও মথুরার মসজিদের জায়গা হিন্দুদের ছেড়ে দিক মুসলিমরা। তাঁর কথায়, অযোধ্যায় রাম মন্দির হয়েছে। বারাণসী ও মথুরার মন্দির পুনঃনির্মাণের জন্য মসজিদের জমি প্রয়োজন। মন্দির ভেঙে মোঘল সম্রাটেরা ওই মসজিদ তৈরি করেছিলেন।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *