হিন্দুদের কাছে কামাখ্যা মন্দির কেন এত পবিত্র? কামাখ্যা মন্দির কেন শক্তিপীঠ হিসাবে পরিচিত জানেন? অম্বুবাচী নিয়ে তৈরী কামাখ্যা মন্দিরের আসল রহস্য কি জানেন ? দুর্গাপুজোয় কেন এখানে এত ভক্ত সমাগম হয় জানেন? মহামায়া কেন এখানে কামাখ্যা রূপে পূজিত হয় জানেন? কেন এই মন্দিরে কোন মূর্তি পূজা হয় না জানেন? জানলে অবাক হবেন এই মন্দিরের নামকরণের পিছনে থাকা অজানা কাহিনী!
হিন্দুদের একান্ন শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম কামাখ্যা মন্দির। অসমের রাজধানী গুয়াহাটির পশ্চিমাংশে অবস্থিত নীলাচল পাহাড়ের কোলে রয়েছে এই কামাখ্যা মাতার মন্দির। প্রাচীন এই হিন্দু মন্দিরটি তান্ত্রিকদের কাছেও কালা জাদু এবং তন্ত্রসাধনার অন্যতম আখড়া। বশীকরণের জন্য এখনও এখানে নানা ধরনের যাগযজ্ঞ করা হয়। এখানে দেবী মহামায়া এখানে কামাখ্যা রূপে বিরাজমান। কামাখ্যা মন্দিরটি মূর্তিহীন মন্দির।
হিন্দু পুরাণ মতে কথিত আছে দেবী সতী দেহত্যাগের পর মহাদেব তাঁর দেহ নিয়ে প্রলয় নিত্য করলে তাঁকে থামানোর জন্য বিষ্ণুদেব তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর মৃতদেহ খন্ড বিখন্ড করে দিয়েছিলেন। এতে সতীর দেহ ৫১ টি খন্ডে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পড়ে এবং যা পরবর্তীতে পবিত্র শক্তিপীঠ নামে পরিচিতি পায়। কামাখ্যা মন্দিরও সেই ৫১ শক্তি পীঠের মধ্যে অন্যতম। এই মন্দিরের গর্ভগৃহটি আসলে ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। মন্দিরের গর্ভগৃহে কোন মূর্তি নেই।
এখানে শুধু প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর পাথরের সরু একটি গর্ত রয়েছে। সেখানেই যোনির আকৃতি বিশিষ্ট ঢালু একটি পাথরের খণ্ড রয়েছে।একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সারাবছর ভর্তি থাকে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে বিশ্ব বিখ্যাত। এছাড়াও কামাখ্যা মন্দির চত্বরের অন্যান্য মন্দিরগুলিতেও একই রকম যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর দেখা যায়, যা ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল দ্বারা পূর্ণ থাকে।
হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে ধরিত্রী মা ঋতুময়ী হয়। এই সময়টিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। আর এই অম্বুবাচী উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মানের এক বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়এই মন্দির চত্বরে। যার সাক্ষী থাকতে হাজির হন লক্ষ লক্ষ ভক্তরা। এই অম্বুবাচীর তিন দিন দেবী দর্শন নিষিদ্ধ থাকে তাই বন্ধ থাকে মন্দিরের দরজা। অম্বুবাচীর শেষ দিন ভক্তদের রক্তবস্ত্র উপহার দেওয়া হয়। ভক্তদের বিশ্বাস দেবী পীঠের সেই রক্তবস্ত্র ধারণ করলে সমস্ত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। দুর্গাপুজোর সময়ও এখানে ঢল নামে ভক্তদের।
আমাদের দেশের প্রাচীন এই মন্দিরটি আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ প্রথমবার এই মন্দির সংস্কার করেছিলেন। পরবর্তীতে এই মন্দির আরও একবার সংস্কার করেন রাজা রুদ্র সিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবা সিংহ। পরবর্তীতে এই মন্দিরের দায়িত্ব তিনিই দিয়েছিলেন মহন্ত কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যকে।
আগেই বলেছি মানুষের বিশ্বাস এখানেই সতীর দেহত্যাগের পর বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে যোনি ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বারাণসীর বৈদিক ঋষি বাৎস্যায়ন খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে নেপালের রাজার দ্বারস্থ হয়ে উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলিকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত ও তাদের নরবলি প্রথার গ্রহণযোগ্য বিকল্প চালু করার জন্য অনুরোধ করেন। সেসময় পূর্ব হিমালয়ের গারো পাহাড়ে তারা দেবীর তান্ত্রিক পুজো করা হতো। সেখানেই আদিবাসীরা দেবীর যোনিকে ‘কামাকি’ নামে পুজো করতেন। ব্রাহ্মণ্যযুগে কালিকাপুরাণে সব দেবীকেই মহাশক্তির অংশ বলা হয়েছে। সেই হিসেবে, কামাখ্যাও মহাশক্তির অংশ হিসেবে পূজিত হন।
Leave a Reply