খনার বচন

খনা কে? খনার বচন কী? সত্যিই কি এই নামের কোনো মহিলা ছিলেন? তাঁর আসল নাম-পরিচয়ই বা কি? খনার বচন এত নির্ভুল কেন? সত্যিই কি খনার জিভ কেটে নেওয়া হয়েছিল? টিকটিকি কি সত্যিই খনার জিভ খেয়েছিল? কি বলছে বিজ্ঞান?  বিদুষী এই  নারীর মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? এখনই জানুন আসল সত্যি।

খনা ছিলেন গ্রাম বাংলার এমন একজন বিদুষী নারী, লোকমুখে যার নামে প্রচলিত আছে একাধিক ছড়া বা বচন। সেইসব বচনে দেখা যায় কৃষি, খাদ্য এবং আবহাওয়ার বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য রয়েছে খনার। কখন কোন কাজ করা শুভ হবে, কোন মাসে কোন ফসলের বীজ বপন করলে ভালো ফলন হবে, কোন পরিস্থিতিতে ঝড়,বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে ইত্যাদি সব বিষয়েই বাস্তবসম্মত উপদেশ ছিল তার।

খনার বচন নিয়ে আজও উপকথা। এরমধ্যে কয়েকটি সত্যি বলে মনে করা হলেও বেশিরভাগই মিথ। প্রসঙ্গত খনার বচনের কোনো লিখিত রূপ ছিল না। এতদিন প্রজন্মের পর প্রজন্মের ধরে এগুলো মানুষের মুখে মুখে বেঁচে ছিল। এই যেমন টিকটিকি নিয়ে গ্রাম বাংলায় প্রচলিত একটি বিশ্বাস আছে। কেউ  কোনো কথা বলার সময় টিকটিকি যদি পরপর তিনবার ঠিক ঠিক ঠিক করে ডেকে উঠে তাহলে সকলে ধরে নেয় কথাটা সত্যি।

কিন্তু টিকটিকি কীভাবে ওই ঘটনার ঠিক বেঠিক জানলো? আসলে এর পিছনেও রয়েছে খনার লোকজ ইতিহাস। কিন্তু তখনকার দিনে একজন নারীর এমন জ্ঞানের গরিমা সহজভাবে নেয়নি খোদ তাঁর স্বামী এবং শ্বশুর। তাই হিংসা থেকে শাস্তি দিতেই জিভ কেটে দেওয়া হয়েছিল খনার।

প্রচলিত জনশ্রুতি মতে খনার জিভের সেই কাটা অংশই নাকি খেয়ে ফেলেছিল  টিকটিকি। ফলে টিকটিকি জ্ঞান লাভ করে খনার। সেই থেকেই নাকি  ভালো-মন্দ, সঠিক-বেঠিক, সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জ্ঞান লাভ করেছে টিকটিকি। বলা হয় বর্তমানে যেসব টিকটিকি দেখা যায়  তার সবই নাকি  সেই খনার কাটা জিভ খাওয়া টিকটিকির বংশধর।

তবে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে কিন্তু এই ঘটনার সাথে টিকটিকির কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ কেউ  কারও  জিভ খেয়ে  তার জ্ঞান অর্জন করতে পারে না।তাছাড়া জ্ঞান থাকে মস্তিষ্কে,জিহ্বাতে নয়।  তাছাড়া টিকটিকির পক্ষে মানুষের ভাষা বোঝাও সম্ভব নয়। ক্ষমতা নেই সত্য-মিথ্যা যাচাই করার-ও। তাই এই  ঘটনা লোকবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

তবে টিকটিকির জিভ  খাওয়ার  ঘটনা মিথ হলেও বাস্তবে খনা নামে সত্যিই একজন জ্ঞানী নারী ছিলেন এবং কোনো কারণবশত তার জিভ-ও  কেটে ফেলা হয়েছিল। তবে তাঁর জন্ম কোথায় হয়েছিল? তিনি কিভাবে বেড়ে উঠেছিলেন, পিতামাতা কে, এসব ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

খনা কে ছিলেন?

খনার নাম পরিচয় নিয়ে প্রচলিত রয়েছে বেশ কিছু জনশ্রুতি। তেমনই একটি  প্রচলিত গল্প কথা থেকে জানা যায় এক সময় রাক্ষস ময়দানব নাম লঙ্কা দ্বীপে একজন  রাজা ছিলেন, তাঁরই মেয়ে ছিলেন খনা। তবে  শত্রু পক্ষের রাক্ষসরা ময়দানবকে সবংশে ধ্বংস করে দিলেও খনার প্রতি স্নেহ পরবশ হয়ে তাকে তারা বাঁচিয়ে রেখেছিল। তারাই খনার  মধ্যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেখে, তাকে জ্যোতিষ শাস্ত্র শিখিয়ে পারদর্শী করে তোলে।

এছাড়া  ইতিহাসের পাতা উল্টে জানা যায় খনার জন্ম খ্রিষ্টীয় ৮০০ সালের দিকে, বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতের কাছাকাছি বেড়াচাঁপার চন্দ্রকেতুগড়ে। খনার বলা একটা শ্লোক থেকেই অনুমান করা হয় তাঁর বাবার নাম আটনাচার্য। সেই শ্লোকে খনা বলেছিলেন ‘আমি অটনাচার্যের বেটি, গনতে-গাঁথতে কারে না বা আঁটি।’

চন্দ্রকেতুগড় এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ। তবে খনা যে এখানেই যে বাস করতেন,তার কোনো অকাট্য প্রমান নেই। আসলে ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করেন,তাদের লোককথা আর নথিপত্র মিলিয়েই দুইয়ে দুইয়ে চার করা হয়েছে সবটাই।

রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ্যের রাজ জ্যোতিষবিদ ছিলেন বরাহ। তাঁরই ছেলে মিহির ছিলেন খনার স্বামী। কথায় কথায় শ্লোক আউড়ে খনা যেভাবে নিজের  জ্ঞানের প্রকাশ ঘটাতেন, যা খণ্ডন করার সাধ্য ছিল না কারও। একদিন পিতা বরাহ এবং পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পড়লে, খনা সেই সমস্যার সমাধান করে  রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। খনার দেওয়া পূর্বাভাস গণনা করেই উপকৃত হতেন রাজ্যের কৃষকরা। তাই  রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন খনাকে। খনার এই জ্ঞানের বহর আঁতে ঘা দিয়েছিল তাঁর স্বামী এবং শ্বশুরের। শোনা যায় রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে প্রতিহিংসায় বরাহের আদেশে মিহির তার স্ত্রী খনার জিভ  কেটে নিয়েছিলেন।

তিনি এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, যা মিলে জেট  হুবহু। তখনকার দিনে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয় যেমন হাতগননা, শস্যগণনা , বন্যা , বৃষ্টি , কুয়াশা বার গনানা , জন্ম-মৃত্যু গননা , শুভ-অশুভ গননা , ইত্যাদি ক্ষেত্রে খনার বচন ছিল নির্ভুল। তবে জিভ কেটে নেওয়ার কিছুকাল পরেই নাকি খনার মৃত্যু হয়েছিল।

কথিত আছে, জিভ  কেটে ফেলার আগে খনা জানিয়েছিলেন তার কিছু কথা বলার আছে। তাকে বলার অনুমতি দেওয়া হলে সেসময় কেউ একজন খনার বলা কথাগুলো লিখে রাখার  কিংবা শ্রুতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। সেগুলোই পরবর্তীতে খনার বচন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

ঐতিহাসিকদের মধ্যে খনার নাম নিয়েও রয়েছে দ্বিধা। বেশির ভাগ মানুষই মনে করেন খনার আসল নাম লীলাবতী। তবে তিনি কিন্তু বিখ্যাত গণিতবিদ ভাস্কারাচার্যের মেয়ে লীলাবতী নন। জিভ কেটে নেওয়ার পর খনার মুখ থেকে যখন  কথা বেরোত না, তখন শুধু খনখনে আওয়াজ হতো। সম্ভবত সেই থেকেই লীলাবতীর নাম হয়ে যায় খনা। তাছাড়া উড়িয়া ভাষায় খোনা মানে হলো বোবা। লীলাবতীর জিব কেটে দেবার ফলে তিনি বোবা হয়ে যান বলে সেখান থেকেও তার নাম খোনা বা খনা হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও বলা হয়, শুভক্ষণে জন্মেছিলেন বলেই তার নাম দেওয়া হয়েছিল খনা।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *