‘টুয়েলভথ ফেল’ মনোজ শর্মা

টুকে পাশ করতে গিয়েই উচ্চ মাধ্যমিক ফেল! অটোচালক থেকে IPS, মাথার ছাদ না থাকায় শুতেন ভিখারিদের সঙ্গে! কীভাবে অসম্ভব কে সম্ভব করলেন মনোজ শর্মা? জানেন ‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমার মনোজ শর্মা আসলে কে? চিনে নিন বলিউড সিনেমার এই রিয়েল লাইফ হিরোকে।

গোটা দেশজুড়ে এখন সিনেমা প্রেমীদের মুখে মুখে একটাই নাম, তা হলো ‘টুয়েলভথ ফেল’। বিধু বিনোদ চোপড়া পরিচালিত এবং বিক্রান্ত মেসে অভিনীত এই সিনেমা আসলে IPS অফিসার মনোজ শর্মার বাস্তব জীবনের কাহিনী। যা নিয়ে এখন তোলপাড় গোটা দেশ। উচ্চমাধ্যমিক ফেল করা এক ছাত্রের পেটের দায়ে অটো চালক থেকে IPS অফিসার এই কাহিনী এখন অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে আমাদের দেশের হাজার হাজার ছেলেমেয়েদের। তাই ‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমার রিয়েল লাইফ মনোজ শর্মা এখন অনুপ্রেরণার নতুন নাম। দেশবাসীর কাছে তিনিই এখন বাস্তব জীবনের হিরো।

মধ্যপ্রদেশের মোরেনা জেলায় অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম বিলগাঁওয়ের এক নিন্মবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মনোজ শর্মা দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে মনের জোর আর অদম্য সাহসের ওপর ভর করে মানুষের স্বপ্ন পূরণের চাহিদা দুনিয়া বদলে দিতে পারে। মনোজ শর্মার কথায় , ‘জিততে গেলে লড়তে হবে। হারা ওহি জো লড়া নহি।’

জানলে অবাক হবেন ছোট থেকে পড়াশোনায় মোটেই ভালো ছিলেন না মনোজ। ভেবেছিলেন যা হোক করে উচমাধ্যমিক পাশ করেই টাইপিং শিখে ছোটোখাটো চাকরি জোগাড় করে নেবেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল অন্য কিছু। মনোজ নিজে কোনোদিন জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। এমনকি স্কুল জীবনে-ও  টুক পাশ করেছেন একাধিকবার। টুকলি করেই তিনি কোনো মতে পাশ করেছিলেন নবম,দশম আর একাদশ শ্রেণী। কিন্তু আটকে যান উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়। দ্বাদশ শ্রেণিতে টুকলির উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন মহকুমাশাসক। তাই উচ্চ মাধ্যমিকে হিন্দি ছাড়া বাকি সব বিষয়ে ফেল করেছিলেন মনোজ।

 

মহকুমাশাসকের কড়া নির্দেশের কারণে পরীক্ষায় পাশ করতে না পাড়ার ঘটনা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল মনোজের জীবনে। সেসময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শিক্ষক এবং প্রিন্সিপালের উপরে-ও কেউ আছেন। তাঁর কথায়, “টুকলি করতে না পেরে ভেবেছিলাম, এমন কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি যাঁর নির্দেশে টুকলি বন্ধ করে দেওয়া হল? সেই সময় থেকেই সিদ্ধান্ত নিই, কোনও কিছু যদি করতেই হয়, তা হলে জেলাশাসকের মতো ক্ষমতাবান ব্যক্তিই হব।”

উচ্চ মাধ্যমিকে ফেল করার পর দাদার সঙ্গে অটো চালানোর কাজ শুরু করেন মনোজ। সেখান থেকেই ঘুরতে শুরু তাঁর ভাগ্যের চাকা। তবে সেই পথ মসৃণ ছিল না একেবারেই। একবার এক পুলিশ আধিকারিক মনোজ শর্মার অটো আটক করেছিল। তখন অটোটিকে ছাড়িয়ে আনতে মহকুমা শাসকের অফিস  পৌঁছান মনোজ।

এরপর ওই মহকুমা শাসকের সাথে এক দিনের সাক্ষাৎ-ই বদলে দেয় তাঁর জীবন। মনোজ শর্মার কথায় ‘মহকুমাশাসকের কাছে যে কাজের জন্য গিয়েছিলাম, সেই কাজের কথা দূরে সরিয়ে রেখে মহকুমাশাসক হতে গেলে কী ভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়, সেই কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁর কথা শোনার পর স্থির করেছিলাম আমাকে মহকুমাশাসকই হতে হবে।

এরপরেই তাঁর মনের মধ্যে জেদ তৈরী করেছিল  UPSC পরীক্ষায় বসার  স্বপ্ন। তাই ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন গোয়ালিয়র। শুরুতে টেম্পো চালিয়ে, ছোট-খাটো কাজ করেই  লড়াই শুরু করেন তিনি। সে সময়  মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুও ছিল না তাঁর। তাই একসময় বাধ্য হয়েই  দিনের পর দিন ফুটপাথে ভিখারিদের সাথে  শুয়ে রাত কাটিয়েছিলেন মনোজ।

একটা সময় ভাগ্য দেবী প্রসন্ন হয়।  লাইব্রেরিতে পিয়নের কাজ পেয়ে যান মনোজ। সেই সূত্রেই একাধিক বই পড়ার সুযোগ পেয়ে যান তিনি।সেখান থেকেই ধীরে ধীরে শুরু করেন UPSC-র প্রস্তুতি। এরপর সেখানে থেকে সোজা চলে যান দিল্লিতে। সেখানে ধনী পরিবারের  কুকুরদের দেখভালের কাজও করেছেন। তার জন্য মাসে ৪০০ টাকা বেতন পেতেন মনোজ। এরপর ওই টাকা দিয়েই পড়াশোনা শুরু করেন মনোজ। কলেজ উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুলিশের পরীক্ষায় বসেন তিনি। প্রথম প্রচেষ্টায় প্রিলিমিনারি পাশ করলেও চূড়ান্ত পরীক্ষায় ব্যর্থ হন তিনি।

UPSC পরীক্ষায় তিনবার ব্যর্থ হন মনোজ শর্মা। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ অ্যাটেম্পটে ১২১ ব়্যাংক করেন তিনি। IPS হয়ে মহারাষ্ট্রে কাজে যোগ দেন। আর এই লড়াইয়ের তাঁর সব সময়ের সঙ্গী ছিলেন প্রেমিকা শ্রদ্ধা। UPSC কোচিং করার সময়েই  উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা শ্রদ্ধা জোশীর প্রেমে পড়েন মনোজ। বর্তমানে তিনিই মনোজ শর্মার স্ত্রী।  ২০০৭ সালে শ্রদ্ধা জোশীও ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আইআরএস অফিসার হয়েছিলেন। মনোজ কুমার শর্মার বন্ধু অনুরাগ পাঠক তাঁর বই ‘টুয়েলফথ ফেইল, হারা ওহি জো লড়া নেহি’-তে মনোজ কুমারের বাস্তব জীবনের  কাহিনি বর্ণনা করেছেন। এই বায়োগ্রাফি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই পরিচালক বিধু বিনোদ চোপড়া এই টুয়েলফথ ফেইল ছবিটি তৈরী করেছেন।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *