গোত্র কি? হিন্দুধর্মে একই গোত্রের ছেলে-মেয়ের বিয়ে কেন নিষিদ্ধ? সত্যিই কি একই গোত্রের মধ্যে বিয়ে করা উচিত নয়? সবটাই কি শুধু পৌরাণিক বিশ্বাস? কি বলছে বিজ্ঞান? হিন্দুধর্মে গোত্র কেন এত গুরুত্বপূর্ণ জানেন? গোত্রের উৎপত্তি হল কিভাবে?
হিন্দু ধর্মে গোত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কোন বিয়ে, পুজো কিংবা যে কোনো অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে গোত্র জানতে চাওয়া হয়। পুরনো নিয়ম মেনে এখনও একই গোত্রের ছেলে মেয়ের মধ্যে বিয়ে হয় না। যদিও সবাই যে এই নিয়ম মেনে চলেন তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল সত্যিই কি একই গোত্রের মধ্যে বিয়ে করা উচিত নয়?
গোত্র কী?
হিন্দু ধর্মের বিশেষজ্ঞদের মতে এক এক প্রাচীন ঋষির নাম অনুসারে এক একটি গোত্র তৈরি করা হয়েছে। তাই নির্দিষ্ট গোত্রের মানুষ সেই ঋষির বংশধর বলে মনে করা হয়। প্রাচীনকালে ঋষি ভরদ্বাজের নাম অনুসারেই নামকরণ হয়ছে এই গোত্রের। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, গোত্র দিয়ে কে কোন পূর্বপুরুষের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত তা জানা যায়।
ঋকবেদে গোত্রের অর্থ হল গরুর পাল। উপনিষদে আবার গোত্র বলতে মানবগোষ্ঠীকেও বোঝানো হয়েছে। এই গোত্র সাধারণত মানুষের বংশ পরিচয়ের মত। বংশপরিচয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গোত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এক গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ
রাশিফল মেলানোর ক্ষেত্রেও গোত্রের বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ পরিবারে গোত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বাস করা হয়, একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হয় না। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে এক গোত্রের পাত্র ও পাত্রীর বিয়ে হয় না। এর পিছনেও রয়েছে একটি পৌরাণিক বিশ্বাস।
পৌরাণিক বিশ্বাস
পৌরাণিক মতবাদ অনুসারে গোত্র প্রাচীনকালের মুনি ঋষিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই হিন্দু ধর্মের প্রত্যেক নারী পুরুষ কোনও না কোনও গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। সেই হিসেবে পাত্র ও পাত্রীর গোত্র এক হলে তারা সম্পর্কে ভাইবোন হয়ে যান। এই কারণেই একই গোত্রে বিয়ে হিন্দু ধর্মে সিদ্ধ নয়। তাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হয় না। শুধু তাই নয়, একই গোত্রের ছেলে-মেয়ের বিয়ে হলে সন্তান লাভে বাধা আসে। এমনকি জন্মের পর সেই সন্তানের জিনে জেনেটিক বিকৃতি দেখা দেয়। এরফলে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকৃতি হতে পারে।
তাই এই প্রথা প্রাচীন হলেও, এখনও ভারতের অনেক পরিবারে এই নিয়ম মেনে চলেন। তাছাড়া এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজের পছন্দে বিয়ে করলেও পরিবারের সম্মতি নেওয়ার সময় কথা ওঠে কুষ্ঠী বিচার আর গোত্রের।
বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব
বিজ্ঞানীদের মতে, জিনগত অমিল এবং হাইব্রিড ডিএনএর কারণে আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তানের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ একই গোত্রেবিয়ে করলে সেই বংশের দোষ, রোগ, কুফল পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। তাই ভিন্ন গোত্রে বিয়ে করলে সন্তান এই সব দোষ ও রোগ মুক্ত হয় এবং সন্তানরা আরও বিচক্ষণ হয়।
বিভিন্ন গোত্র
হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গোত্র গুলি হল অগস্ত্য, শান্ডিল্য, কাশ্যপ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, বশিষ্ঠ, পরাশর, বৃহস্পতি, বাসুকি, ভরদ্বাজ, সাবর্ণ, অত্রি, কাঞ্চন, কৌশিক, গর্গ। এগুলি সবই প্রাচীন কালের কোনও না কোনও ঋষির নাম।
গোত্র কীভাবে আলাদা আলাদা করে বলা হয়, তা জানেন?
প্রাচীন ভারতে সাত ঋষির সন্তান,মহর্ষি বিশ্বামিত্র, জনদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ ও অষ্টম ঋষি অগস্তি ঋষির নামে গোত্রের নামকরণ করা হয়। ধীরে ধীরে গোত্র ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিয়ে আর পুজোর সময় গোত্রের ব্যবহার শুরু হয়। যেহেতু ঋষির সংখ্যা লক্ষ কোটি ছিল, গোত্রের সংখ্যাও লক্ষ কোটি বলে ধরা হয়। তবে মূল আটটি গোত্রকে আটজন ঋষির নামে নামকরণ করা হয়। তাদের বংশেই অন্যান্য গোত্র সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই গোত্রের থেকেও আরও ৪৯টি উপগোত্র তৈরী হয়। মহাভারতের শান্তি পর্বে রয়েছে মূল চারটি গোত্র- অঙ্গিরা, কাশ্যপ, বশিষ্ঠ ও ভৃঙ্গু।
সমগোত্র
সমগোত্র মানে একই পিতৃবংশ, অর্থাত্ একই ঋষির বংশধর। তবে এক্ষেত্রে শাস্ত্রের একটি বিধানও রয়েছে। কেউ চাইলে ১৪ পুরুষ পেরিয়ে গেলে সমগোত্রে বিয়ে করতে পারেন। অনেকে আবার বিয়ের আসরে পাত্রীর গোত্রান্তর করে তারপর সমগোত্রের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে পাত্রীর মামা তাকে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করলে সে মামার বাড়ির গোত্র গ্রহণ করে। তারপর মামা সম্প্রদান করে তার বিয়ে দেয়।
Leave a Reply