মা কালী

মা কালী যেন বাংলার প্রত্যেক ঘরের সেই অবহেলিত কালো মেয়েটি। সবার চোখের আড়ালেই থেকে যাওয়া সেই কালো মেয়েটিই জগতের আলো। আবার তিনিই পারেন সমাজের সমস্ত প্রচলিত নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। তাই যে সমাজ স্ত্রীকে স্বামীর পথ সেবা করতে বলে সেখানে স্বয়ং দেবাদিদের মহাদেব মাকালীর  পদতলে শায়িত থাকেন। বাংলায় যে প্রচলিত কালীমূর্তি দেখা যায় তাতে এইরূপেই দেখা যায় মা কালী আর দেবাদিদেব মহাদেবকে।

দেবী দুর্গার পাশে শিবকে নানা ভাবে দেথা যায়। তার মধ্যে হরগৌরী রূপ বিখ্যাত। তবে মা কালীর সঙ্গে শিব থাকলে তার জায়গা সবসময় দেবীর পদযুগলের নিচেই হয়। এই বিগ্রহে যদি মা কালীর ডান পা এগিয়ে থাকে তবে তিনি দক্ষিণাকালী আর বাঁ পা এগিয়ে থাকলে তবে তিনি হন মায়ের বামাক্ষ্যাপা রূপ। তন্ত্র পুরানে দেবীর একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কালী শব্দটির ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় কাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ কালী। এই শব্দের অর্থ কালো বা ঘোর বর্ণ। এখানে কালো মানে বর্ণাতীত। সকলেই জানেন কালোর মধ্যেই সব বর্ণ মিলে যায়। তাই কালো এই জগতের আলো।  কখনও আবার দেবীকে গাঢ় নীল বর্ণের দেখা যায়। কারণ তিনি গাঢ় নীল আকাশের মতই অনন্ত অসীম।

তবে বাংলায় কালীমূর্তির যে রূপ প্রচলিত রয়েছে তার পেছনে রয়েছে একটি প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী। ব্রহ্মার বরেই রক্ত বীজের এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লেই হাজির হচ্ছিল সহস্র অসুর বাহিনী। সেসময় অসুরকুলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা শরণাপন্ন হয়েছিলেন মহামায়া দেবী দুর্গার। তাই অসুর নিধন করতে দেবী দুর্গার রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন স্বয়ং মহামায়া। তবে সব অসুর নিহত হলেও বেঁচেছিল রক্ত বীজ। তাই দুর্গার ভীষণ ক্রোধে তাঁর দুই ভ্রুর মাঝখান থেকে জন্ম নিয়েছিলেন দেবী কালী।

সেসময় নগ্নিকা কালী তাঁর ভয়াল দৃষ্টি, আর রক্তবরণ লকলকে জিব বের করে গ্রাস করে নেন হাতিও ঘোড়ার সওয়ার অসুর বাহিনীকেও। তারপর পালা আসে রক্তবীজের। রক্তবীজের একফোঁটা রক্তও যাতে মাটিতে না পড়ে তাই রক্তবীজের দেহ শুন্যে তুলে ধরেন দেবী। এরপর প্রচন্ড ক্রোধে রক্তশূণ্য রক্তবীজের নিথর দেহ ছুড়ে ফেলে দেন মা কালী।

আকণ্ঠ রক্ত পান করে ততক্ষণে প্রলয় নৃত্য শুরু করে দিয়েছেন  মা কালী। কিন্তু আদ্যাশক্তির সেই রূপ এতটাই ভয়ংকর ছিল  যে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেবও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই  সৃষ্টিকে রক্ষা করতে কোনো উপায় না পেয়ে দেবীর সামনে সটান শুয়ে পড়েন মহাদেব। ভুল করে তখন মহাদেবের বুকে এক পা রাখেন দেবী। আর  পা মাটিতে রেখেই  লজ্জায় জিভ কেটে ফেলেন তিনি। সেই কালীমূর্তিই আজও প্রচলিত বাংলায়। দক্ষিণাকালীর ধ্যানেও এই যুক্তিকে মান্যতা দেওয়া  হয়েছে।

শাস্ত্রজ্ঞদের মতে এই শিবারূঢ়া দেবীর বিবর্তনে সাহায্য করেছে দুটি উপাদান। প্রথমত, পুরুষ ও প্রকৃতির তত্ত্ব। যার একদিকে, নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয় পুরুষ। আর  দ্বিতীয়ত, তন্ত্রের ‘বিপরীত রতাতুরা’ তত্ত্ব। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনই সৃষ্টির মূলকথা। তাই শাস্ত্রমতে, মহাকালীও চৈতন্যময় মহাকাল শিবের সংযোগে সেই সৃষ্টিকর্মেই নিয়োজিতা।

দার্শনিক অর্থ

এই প্রচলিত কালীমূর্তিতে দেবী নিজের একটি পা শবরূপী শিবের বুকের ওপর রেখেছেন। সামনের দিকে থাকা  এই  পা হল, গতির প্রতীক। আর একটি পা পিছনে।  এর অর্থ হল, অতীতকে এবং ভবিষ্যতকে একসাথে অধিকার করে নিয়ে তিনি গতিশীলা। আবার  শিব স্থির, কালী গতিময়ী।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *