আজ থেকে ৩৯ বছর আগে নিজের নিরাপত্তা রক্ষীদের ছোঁড়া গুলিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেদিন তাঁর প্রয়াণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল গোটা ভারতবর্ষ। দিনটা ছিল ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর, প্রধানমন্ত্রীর দুই দেহ রক্ষী বিয়ন্ত সিং এবং সতবন্ত সিং শিখদের অপমান এবং ব্লু স্টার অপারেশনের বদলা নিতে একেবারে সামনে থেকে ৩০ রাউন্ড গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। অনেকেই মনে করেন ইন্দিরা গান্ধী আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন তার মৃত্যু অনিবার্য।
নিজের মৃত্যুর আগের দিন ভুবনেশ্বরে শেষ ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন ‘আমি জীবিত থাকি অথবা না থাকি, আমার জীবন যথেষ্ট দীর্ঘ হয়েছে। এই জীবন নিয়ে আমার গর্ব রয়েছে।’
অপারেশন ব্লুস্টারের পরদিন এবং পরবর্তী সময়ে খোদ ইন্দিরা গান্ধী সেসব কথা তাঁর পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে বলে গিয়েছেন। তাই সেসময় ইন্দিরা গান্ধীর নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছিল। পুলিশ নয় সেসময় তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে সেনাবাহিনী রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু, ইন্দিরা গান্ধী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে সেসময় তাঁর নিরাপত্তায় নিযুক্ত ছিলেন ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের কমান্ডো। বাড়ানো হয়েছিল তাঁর পরিবারের বিশেষ করে তাঁর নাতি-নাতনি, রাহুল- প্রিয়াঙ্কার নিরাপত্তাও।
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন
গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সুপারিশ অনুযায়ী এই পরিস্থিতিতেও নিজের সুরক্ষা থেকে শিখ জওয়ানদের অপসারণ করতে প্রত্যাখ্যান করে ইন্দিরা গন্ধী বলেছিলেন, ‘আমরা কি ধর্মনিরপেক্ষ নই?’
রক্ষীরাই তাঁকে গুলি করেছিল
৩১ অক্টোবর প্রায় সকাল ১০ নাগাদ, ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লির ১, সফদরজং রোডে তাঁর সরকারি বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ১, আকবর রোডের পাশের বাংলোতে তাঁর ব্যক্তিগত অফিসের দিকে রওনা হন। তখন তাঁর নিজের বাড়িতে, তাঁর নিজের বিশ্বস্ত দেহরক্ষীরাই গুলি করেছিল।সেই অভিশপ্ত সকালে তিনি বাগানের পথ ধরে এগোতে গেলে সেসময় তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘদিনের সদস্য, সাব-ইন্সপেক্টর বিয়ন্ত সিং এগিয়ে আসেন। আর তার কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন নতুন নিযুক্ত কনস্টেবল সতবন্ত সিং।
অভিবাদনের বদলে গুলি
ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত ব্যক্তি তথা জীবনীকার পুপুল জয়কার লিখেছেন, ‘তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) হেসে অভিবাদন জানাতে গিয়েও তাঁর হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি দেখতে পান, যে বিয়ন্ত সিং তাঁকে অভিবাদন করার জন্য যে হাত তুলেছেন, সেই হাতে একটি রিভলভার ধরা আছে। বিয়ন্ত তাঁকে তিন ফুট দূর থেকে পেটে গুলি করেছিল।’ এরপর সতবন্ত সিং ইন্দিরাকে তাঁর ৩০ রাউন্ড স্টেন গানের ক্লিপ খালি করার আগে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে আরও চারটি গুলি চালায়। এই গুলিবর্ষণ প্রায় ২৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল। এই সময় ইন্দিরা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
কীভাবে মৃত্যু হয় ইন্দিরা গান্ধীর?
সেসময় ইন্দিরা গান্ধীর কনস্টেবল দয়াল হত্যাকারীদের গুলি করার আগেই, তাঁর নিজের উরুতেই গুলি লাগে। গুলি করার পর বিয়ন্ত সিং এবং সতবন্ত সিং নিজেদের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দেয়। আর বিয়ন্ত পঞ্জাব ভাষায় বলে ওঠে, ‘আমার যা করার ছিল তা করেছি। এখন আপনাদের যা করতে হবে, তা করুন।’ দু’জনকেই এরপর দ্রুত নারায়ণ সিং এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত আইটিবিপি কমান্ডোরা ধরে ফেলে।
তখন ৱক্তাক্ত ইন্দিরা গান্ধীকে একটি সাদা অ্যাম্বাসেডরে চাপিয়ে এইমস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তাঁর মাথা ছিল পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর কোলে। দীর্ঘ চার ঘন্টা অস্ত্রোপচারের পর, ব্যর্থ হন চিকিৎসকরা । দুপুর ২টো ২৩ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। হত্যার পরপরই হেফাজতে থাকা অবস্থায় বিয়ন্ত সিংকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সহ-ষড়যন্ত্রকারী কেহর সিং-সহ সতবন্তকে পাঁচ বছর পরে ফাঁসি দেওয়া হয়।
Leave a Reply