লক্ষ্মী সেহগাল

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদহীন ফৌজ বাহিনী। এই নারী বাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন লক্ষ্মী সেহগাল। তাঁর নেতৃত্বাধীন নারী বাহিনী পরিচিত ছিল ঝাঁসির রানী নামে।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিতাড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে উদ্বাস্তু শিবির পরিচালনায় কলকাতা সহ বাংলাদেশের স্মরণার্থীদের চিকিৎসা সব ক্ষেত্রে সমানতালে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন তিনি।

যদিও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় তার নাম এবং অবদানের কথা উল্লেখ নেই সেভাবে। তাই তাকে স্বাচ্ছন্দে তুলনা করা যায় রামায়ণের লক্ষণের স্ত্রী উর্মিলার সাথে। রাম-লক্ষণ-সীতার ১৪ বছরের বনবাসের  সময় অযোধ্যায় একাকী কাটিয়েছিলেন তিনি। তাই যুদ্ধে অংশ না নেওয়ায় গোটা রামায়ণে সীতাকে নিয়েই বন্দনা করা হলেও উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে একই অবস্থা মহীয়সী  লক্ষ্মী সেহগালের। তবে তিনি উর্মিলার মত নতুন ভোরের অপেক্ষায় না থেকে রাতের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

পরাধীন ভারতবর্ষে বেড়ে ওঠার সুবাদে ছোট থেকেই ভারত মাতার একের পর এক বীর সন্তানকে শহীদ হতে দেখেছিলেন লক্ষ্মী। তাই দেশ স্বাধীন করার বীজ তাঁর মনেও গেঁথে গিয়েছিল খুব ছোট থেকেই। ১৯১৪ সালে ২৪ অক্টোবর মাদ্রাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন লক্ষ্মী সেহগাল। যা এখনকার দিনে চেন্নাই নামে পরিচিত। ১৯৩৮ সালে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। এক বছর পর গাইনোকোলজি এবং অবস্টেট্রিক্স বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন তিনি।  এরপর চেন্নাইয়ের ত্রিপলিক্যান এলাকার সরকারি কস্তুর্বা গান্ধী হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন।

১৯৪০ সালে প্রথম সিঙ্গাপুরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভারতীয় জাতীয় সেনা বাহিনীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তাঁর। সেখানেই ভারত থেকে আসার শ্রমিকদের জন্য একটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছিল। এই ভাবেই তিনি ধীরে ধীরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। তার তিন বছর পর ১৯৪৩ সালে সিঙ্গাপুরে আসেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সেখানে এসে তিনি জানিয়েছিলেন পুরুষরা ছাড়াও মহিলারাও যাতে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে পারে তার জন্য এটি নারী বাহিনী গঠন করবেন। নেতাজির এই কথা  শোনা মাত্রই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছিলেন লক্ষ্মী সেহগাল। সেই সময় থেকেই সকলের কাছে  তিনি পরিচিত হন ‘ক্যাপ্টেন’ লক্ষ্মী সেহগাল নামে।

 

পরবর্তীতে তার এবং নেতাজির এই নারী বাহিনী পরিচিতি পায় ঝাঁসির রানী নাম। ১৯৪৫ সালে তিনি গ্রেফতার হন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে এবং তারপর এক বছর বার্মার কারাগারে আটক ছিলেন লক্ষ্মী।  দিল্লিতে আইএনএ সদস্যদের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি অবিভক্ত ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনের পর ওই বছরেই লাহোরে কর্ণেল প্রেম সেহগালের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের পরেও  সেবার কাজ থামাননি তিনি৷ কানপুরে গড়ে তোলেন দাতব্য চিকিৎসালয়। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই  প্রয়াত হন এই মহীয়সী নারী। কিন্তু, আফসোস একটাই তাঁকে  সামনে পেয়েও সম্মান জানাতে ব্যর্থ দেশ। অনেকের মতে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নিয়েই রাজনৈতিক বিভিন্ন নেতার বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি। এই কারণেই স্বাধীনতার ইতিহাসে উর্মিলা হয়েই রয়ে গিয়েছেন তিনি।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *