সুগন্ধির প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। শুধুমাত্র গায়ের দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই নয়, সুগন্ধির সুবাসে মন মেজাজও ভালো হয়ে যায়। অধিকাংশ সুগন্ধি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়, গাছ,পাতা, ফুল-ফল, মূল, কাণ্ডের মতো প্রাকৃতিক উপাদান। এছাড়াও রয়েছে প্রাণীজ সুগন্ধি, যেটা আসে প্রাণীদের দেহ থেকে। যা কস্তুরী সুগন্ধি নামেই পরিচিত। প্রাচীনকালে এই সুগন্ধি ললিতা নামে পরিচিত ছিল। বছরের পর বছর ধরে এই সুগন্ধিই মুগ্ধ করে এসেছে মানবজাতিকে। এই কস্তুরী আসলে হরিণের নাভি থেকে উৎপন্ন এক বিশেষ সুগন্ধী।
যা বিশ্বের সবচেয়ে দামি সুগন্ধি বলে পরিচিত। এর এক তিল পরিমাণ বাড়িতে ফেললেই তার সুগন্ধ থেকে যায় বহু বছর পর্যন্ত। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মত এই কস্তুরী বিভিন্ন নামে পরিচিত। পুরুষ হরিণের এই সুগন্ধি গ্রন্থি রোদে শুকিয়ে কস্তুরী তৈরী করা হয়। যা সবসময় অন্য কোনো পদার্থের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। মিশ্রণভেদে কস্তুরীর বিভিন্ন নাম হয়। কস্তুরীর সঙ্গে চন্দন মেশালে হয় ‘সামামাতুল আম্বার’। আবার কোথাও গন্ধকোলিকা, মার্জারী, বহুগন্ধদা, তো কোথাও যোজনগন্ধা,জনগন্ধিকা,সুভগা,গন্ধধূলী, শ্যামা, আবার কোথাও কামান্ধা, মৃগাঙ্গজা,কস্তুরীকাণ্ডজ, মৃগনাভি, মৃগমদ, মৃগনাভিজ, মৃগনাভিজা,কিংবা কোথাও আবার মৃগাণ্ডজা, গন্ধশেখর,মৃগ, মৃগী, নাভি, মদনী, বেধমুখ্যা, কুরঙ্গনাভী, শ্যামলা, মোদিনী, অন্ডজা, লাক্ষী, বাতামোদ, মার্গ, ললিতা নাড়ী, আবার কোথাও মদ, দর্প, মদাহ্বা, মদার, কস্তুরীকা নামে পরিচিত।
কস্তুরী এক বিশেষ প্রজাতির পুরুষ হরিণের নাভি থেকে উৎপন্ন হয়। এই সুগন্ধি মেয়ে হরিণদের আকৃষ্ট করে। তবে সব পুরুষ হরিণের দেহেই কিন্তু এই কস্তুরী উৎপত্তি হয় না। এই প্রজাতির হরিণকে হিমালয়ের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে দেখা যায়। লাজুক স্বভাবের এই হরিণকে ইংলিশে মাস্ক ডিয়ার বলা হয়। এরা আকারে ছাগলের চেয়ে সামান্য বড় হয়। এদের সামনের দুটি গজ দাঁত দেখেই খুব সহজেই এদের চেনা যায়। শিকারিদের হাত থেকে বাঁচতেই লাজুক স্বভাবের এই হরিণরা নিজেদের সব সময় গোপন করে চলে। কিন্তু এদের নাভির গন্ধই এদের পালাবার পথ বন্ধ করে দেয়।
কস্তুরি কিন্তু হরিণের দেহে জন্ম থেকেই থাকে না, বয়সের সাথে সাথেই এটি হরিণের দেহে তৈরী হয়। হরিণের বয়স দশ বছর হওয়ার আগে এটি শরীরে তৈরি হলেও এই বয়সে এসেই এই সুগন্ধির কোষ পূর্ণতা পায়। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যে হরিণের নাভিতে এই কস্তুরি তৈরি হয়, সেই হরিণটি নিজেই বুঝতে পারে না এই সুগন্ধি আসলে তার দেহেই রয়েছে। তাই নিজের দেহ থেকে বেরিয়ে আসা সুগন্ধি পেয়ে হরিণটি পাগলের মত খুঁজতে থাকে সেই সুগন্ধির উৎস। কিন্তু সে বুঝতে পারে না এই সুঘ্রান আসলে ছড়িয়ে পড়ছে তার নিজের দেহ থেকেই।
যখন কস্তুরী পুরোপুরি পূর্ণতা পায় তখন শিকারীরা হরিণটিকে হত্যা করে নাভি বের করে আনেন। পরিপক্ক কস্তুরীর ওজন হয় ৬০ থেকে ৬৫ গ্রাম। এই সুগন্ধী এতটাই তীব্র হয় যে শিকারীরা এটি বের করার সময় নাকে মোটা কাপড় বাঁধেন। এর তীব্র গন্ধে চোখ মুখ দিয়ে লালা ঝরতে থাকে। যথাযথ সুরক্ষা না পেলে প্রাণহানি ঘটাও অস্বাভাবিক নয়।
Leave a Reply