দীর্ঘ এক বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আবার ‘দোরে দুগ্গা’। বাঙালিদের কাছে দেবী দুর্গা হলেন বাড়ির মেয়ের মত, তাই প্রত্যেক বছর কৈলাস ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে সপরিবারে চার দিনের জন্য মর্ত্যে বাপের বাড়িতে আসেন উমা। পুজোর কটা দিন বাড়ির মেয়ের মতোই আদর-যত্ন করে বিশেষ নিয়ম-আচার মেনে আরাধনা করা হয় দেবী দুর্গার। বাংলায় দেবী দুর্গার যে একচালা ঠাকুর দেখা যায়, তা অত্যন্ত বিরল। মায়ের মাথার মুকুটে শোভা পায় মহাদেবের মুখ। দেবী দুর্গার ডানদিকে শোভা পায় মা লক্ষ্মী আর গণেশ, আর বামদিকে থাকেন দেবী সরস্বতী এবং কার্তিক। প্রত্যেকেরই থাকে নিজের নিজের বাহন। গণেশ ঠাকুরের ইঁদুর, কার্তিক ঠাকুরের ময়ূর, দেবী সরস্বতীর রাজহাঁস আর মা লক্ষ্মীর পেঁচা। তেমনি মা দুর্গার কথা উঠলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিংহের ওপর আসীন সিংহবাহিনী মা দুর্গা।
কিন্তু জানেন কি কেন মা দুর্গার বাহন সিংহ? দেবী কেন সিংহবাহিনী তার সঠিক কারণ হয়তো জানা নেই অনেকেরই। হিন্দু পুরান মতে প্রত্যেক দেবদেবীরই নিজের নিজের বাহন থাকে। প্রায় সকলেই কোন না কোন পশু পাখি উপরের অধিষ্ঠান করেন। দেবতাদের এই প্রত্যেক বাহনেরই রয়েছে বিশেষ অর্থ। শ্রীচণ্ডীতে সিংহকে মহাসিংহ, ধূতসট নামে উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্গাপুজোর সময় আলাদ করে বাহন পুজোরও চল রয়েছে। দেবী পুরাণে বলা হয়েছে, সিংহের শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিষ্ণু, শিব, দুর্গার মতো দেবদেবীরা অবস্থান করেন।
ধ্য়ানমন্ত্রে, সিংহকে বিষ্ণুর একটি রূপ বলে মনে করা হয়। তাই দুর্গার বাহনকে বিষ্ণুরূপী সিংহ বলেও মনে করা হয়ে থাকে। এছাড়া শিবপুরাণ অনুসারে মহিষাসুরকে বধ করার জন্য ভগবান ব্রহ্মা দুর্গাকে সিংহ প্রদান করেন। জঙ্গলের রাজা সিংহ প্রচণ্ড শক্তি, প্রবল রাগ, আক্রমণাত্মক মনোভাব ও রাজকীয় আচরণের প্রতীক। মহিষাসুরকে বধ করতে দেবী চামুণ্ডা রূপ নিয়েছিলেন। তাই সিংহের শক্তি, রাগ ও আক্রমণের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল দেবীর রণহুংকার। এই সাহস, এই নেতৃত্বের শক্তির কারণে সিংহ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীকে দেবী দুর্গার বাহন হিসেবে মানায় না।
দেবী দুর্গার বাহন সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনি
পুরাণ মতে, শিবকে স্বামী হিসেবে পেতে হাজার বছরের কঠিন তপস্যা করেছিলেন দেবী পার্বতী। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব পার্বতীকে বিয়ে করেন। তবে দীর্ঘদিন তপস্যার কারণে দেবী অন্ধকারে একসময় মিশে গিয়েছিলেন। তাই বিয়ের একদিন পরেই তিনি পার্বতীকে কালী বলে ফেলেছিলেন। আর তাতেই অভিমান করে কৈলাস ত্যাগ করে আবার তপস্যায় মগ্ন হয়ে যান তিনি। তখন তপস্যারত দেবীকে শিকার করতে এসেছিলেন এক ক্ষুধার্ত সিংহ।
কিন্তু দেবী কঠিন তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। তখন দেবীর সামনে বসে বসেই তাঁর তপস্যা ভাঙার অপেক্ষা করছিল সিংহ। এইভাবেই বহু বছর কেটে যায়। কিন্তু সিংহ একভাবেই বসেছিল। দেবী পার্বতীর তপস্যা শেষ হলে মহাদেব এবার পার্বতীকে গৌরী বলে সম্বোধন করেন। তবে গঙ্গা থেকে যখন পার্বতী স্নান করে ওঠন, তখন তাঁর শরীরে মরা কোষ থেকে কালো রঙের দেবী কৌশিকী আবির্ভূত হন। পাশাপাশি এতবছর ধরে দেবীর পাশে বসে সিংহটি অপেক্ষা করায় তাকেই নিজের বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন দেবী পার্বতী।
Leave a Reply