ভগৎ সিং মহাত্মা গান্ধী

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অহিংসার প্রতীক। তাই রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র বিপ্লব নয়, শান্তির পথে হেঁটেই স্বাধীনতা লাভের কথা বলে গিয়েছেন আজীবন। তবে গান্ধীজিকে নিয়ে ইতিপূর্বে বহুবার মাথাচারা দিয়েছে একাধিক বিতর্ক। বিশেষ করে ভারতের বীর বিপ্লবী ভগৎ সিং এর ফাঁসির কথা উঠলে বারবার উঠে আসে মহাত্মা গান্ধীর নাম। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ লাহোর সেন্ট্রাল জেলে ভগৎ সিংয়ের সাথেই ফাঁসি হয়েছিল তাঁর আরও দুই বিপ্লবী সঙ্গী রাজগুরু এবং সুখদেবের। যা মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয় প্রত্যেক ভারতবাসীর।

ভারত মাতার এই বীর সন্তানদের হারিয়ে সেদিন অভুক্ত ছিলেন অসংখ্য দেশবাসী। কালো ব্যাজ পরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন অনেকেই।  কিন্তু ইতিহাসবিদদের একাংশ বারবার দাবি করে এসেছেন ভগৎ সিং-এর এই ফাঁসি আটকানোর জন্য নাকি যথেষ্ট চেষ্টা করেননি মহাত্মা গান্ধী। সকলেই জানেন ভগৎ সিং এবং মহাত্মা গান্ধী দুজনেই ইংরেজ শাসনের হাত থেকে দেশ স্বাধীন করতে চাইলেও তাদের দুজনের মতাদর্শ এবং পথ ছিল আলাদা।

তাই তিনি নাকি ভগৎ সিং এর ফাঁসি আটকানোর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেননি। পরাধীন ভারতবর্ষে ভগৎ সিং যেভাবে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তা রীতিমতো ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের। তাই যেন-তেন প্রকারেণ ভারত জুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করতে আইনের বেড়াজাল ডিঙিয়েই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল ভগৎ সিং-কে। যার জন্য তৎকালীন ভাইসরয় সেই সময় জরুরি অবস্থা জারি করে একটা স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। বিচারের জন্য সেন্ট্রাল এসেম্বলি অর্থাৎ ব্রিটিশ সংসদের অনুমতি ছাড়াই অর্ডিন্যান্স পাস করা হয়েছিল। যার সবটাই ছিল বেআইনি।

তাছাড়া ভগৎ সিং-এর ফাঁসির জন্য দায়ী ছিল তাঁর সঙ্গীরাও। তালিকায় রয়েছেন হংসরাজ ভোরা, ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, জয় গোপাল, মনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়রা। সেসময় অর্থবৃত্তি এবং জমির বিনিময়ে দেওয়া তাঁদের সাক্ষ্য প্রমাণও ফাঁসির মঞ্চে ঠেলে দিয়েছিল ভগৎ সিং কে। সেই সময়েই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু শেষমেষ আটকানো যায়নি ভগৎ,শুকদেব এবং রাজগুরুর ফাঁসি। যার জন্য ১৯৩১ সালে করাচিতে কংগ্রেসের অধিবেশনে  রীতিমতো বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। স্লোগান উঠেছিল ‘গো ব্যাক গান্ধী’, ‘লং লিভ ভগৎ সিং।’ তাছাড়াও ভগৎ সিং-এর জীবনীকার জিএস দেওলও গান্ধীকেই ভগৎ সিং এর ফাঁসির জন্য দায়ী করেন। একই দাবি করেছিলেন ভগতের বিপ্লবী সঙ্গী যশপালও।

যদিও এর উল্টো মত রয়েছে। তাছাড়া ভারতবর্ষে  গান্ধীজি এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁকে ভুল বোঝা কোন নতুন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে ভগৎ সিং এর ফাঁসি আটকানোর জন্য সত্যিই কি গান্ধীজি যথেষ্ট চেষ্টা করেননি? কি বলছে ইতিহাস? ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাচ্ছে ১৯৩০ সালের ৪ মে ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি আটকাতে ভাইসরয়কে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন গান্ধী।   সেখানে তিনি পরিষ্কারভাবে লিখেছিলেন এইভাবে আইনি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে যে শর্ট কাট ব্যবহার করা হয়েছে তাকে‘লুকনো মার্শাল ল’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

এরপরেও একাধিকবার ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন গান্ধী। ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি এলাহাবাদের এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘ফাঁসি  তো নয়ই। ভগৎ সিংকে জেলবন্দি করে রাখাই অযৌক্তিক।’  পরবর্তীতে গান্ধীজি তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইনের কাছে একাধিকবার মানবিক আবেদন জানিয়েছিলেন। শোনা যায় ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির আগের দিন অৰ্থাৎ ২২ মার্চ নাকি ভাইসরয় আশ্বাসও দিয়েছিলেন  গান্ধীকে। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা বিফলে যায়। পঞ্জাবের ইউরোপিয়ান আইএএস ও আইপিএস অফিসারদের লাগাতার হুমকির কাছে মাথা নত করলেন ভাইসরয় লর্ড আরউইন। শেষমেশ ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় ফাঁসি হয়ে যায় ভারতমাতার তিন বীর সন্তানের।

১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গাঁধীজি, ভগৎ সিংহকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘তাঁদের মুক্তির জন্য আমাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। ভগৎ সিংহ অহিংসায় বিশ্বাস করতেন না কিন্তু রাষ্ট্রীয় হিংসার কাছেও আত্মসমর্পণ করেননি। অসহায়তার কারণেই তাঁকে বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করতে হয়েছিল।’ সেইসাথে ব্রিটিশ শাসকদের  তীব্র নিন্দা করে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই বীরদের মুক্তির জন্য জাতির সর্বসম্মত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ইংরেজ সরকার এই দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনাটুকুও বিনষ্ট করলেন।’ কিন্তু তারপরেও শুনতে হয় ‘গান্ধী যথেষ্ট চেষ্টা করেননি’। এত বছর পেরিয়ে আজও যা নিয়ে  অব্যাহত চর্চা। কিন্তু গান্ধীর সমালোচকরা ভুলে যান সত্যিই যদি ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি আটকানো যেত তাহলে ভারতবর্ষে গান্ধীর জনপ্রিয়তাই বাড়তো।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *