জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী হলেন গোটা বিশ্বের কাছে অহিংসার প্রতীক। আজীবন তিনি শান্তির বার্তা দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পাঁচ,পাঁচবার মনোনীত হয়েও নোবেল শান্তি পুরস্কার পাননি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কিন্তু কেন? সদ্য গান্ধীজির ১৫৪ তম জন্মবার্ষিকীতে উস্কে দিয়েছে সেই প্রশ্ন। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত পাঁচবার এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন গান্ধীজি। কয়েকবার খুব কাছাকাছি এসেও একটুর জন্য হাতছাড়া হয়েছিল এই পুরস্কার। কিন্তু তারপরেও কেন এই সম্মান উঠল না মহাত্মা গান্ধীর হাতে? এর পিছনে ঠিক কি কারণ ছিল? তা নিয়ে আজও রয়েছে বেশ কিছু রহস্য এবং জটিলতা।
অনেকে দাবি করেন মহাত্মা গান্ধীর নোবেল না পাওয়ার পেছনে রয়েছে নোবেল কমিটি কর্তৃপক্ষের প্রচলিত বিভাগ। আসলে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার জন্য নোবেল কমিটি কর্তৃপক্ষ যে প্রচলিত বিভাগগুলি অনুসরণ করে সেখানে কোনোভাবেই আঁটানো যায়নি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য তাঁরাই যাঁরা রাজনৈতিক নেতা, ত্রাণকর্মী, আন্তর্জাতিক আইনের প্রবক্তা কিংবা আন্তর্জাতিক শান্তি বৈঠকের হোতা বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু এর কোনোটিই মহাত্মা গান্ধী ছিলেন না।
শান্তি এবং অহিংসাকে প্রতিষ্ঠা করতে মহাত্মা গান্ধী যে পথ বেছে নিয়েছিলেন তা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে অনেক মহৎ এবং কঠিন ভাবনা ছিল। কিন্তু গান্ধীজীর অহিংসা নীতির সাফল্য যেহেতু একনজরে ধরা পড়ে না তাই তাঁর অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন করাও হয়তো নোবেল কমিটির কাছে দুষ্কর ছিল। অনেকে এটাও মনে করেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধিতা আর ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের সময়ও লাগাতার তাঁর শান্তির কথা বলে চলা এসব নিয়ে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সংশয় ছিল যা গান্ধীজীর নোবেল পাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এপ্রসঙ্গে নরওয়ের নোবেল পুরস্কার প্যানেলের যুক্তি ছিল, গান্ধীজি শান্তির পক্ষে থাকলেও এক্ষেত্রে তাঁর ধারাবাহিকতার অভাব ছিল। কারণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর বেশ কিছু অহিংস প্রচার, কালক্রমে হিংসা ও সন্ত্রাসবাদে পরিণত হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, এই প্যানেলের একাংশের দাবি ছিল গান্ধীজি আদর্শগুলি সর্বজনীন নয়, বরং ভারত ভিত্তিক। তাছাড়া একটা লম্বা সময় অর্থাৎ ১৯৬০সাল পর্যন্ত, নোবেল শান্তি পুরস্কার একচেটিয়াভাবে ইউরোপীয় এবং মার্কিনীদেরই দেওয়া হয়েছিল।তাছাড়া নোবেল প্যানেলের আরও দাবি ছিল মহাত্মা গান্ধী তখনকার অন্যান্য শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিলেন।
১৯৩৭ সালে, প্রথমবার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রার্থীদের তালিকায় মনোনীত হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর নাম। সেবছর তেরো জন মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে একজন ছিলেন গান্ধীজি । কিন্তু, শেষ পর্যন্ত পুরস্কার উঠেছিল ইংল্যান্ডের চেলউডের লর্ড সিসিলের হাতে। এরপরেও পরপর দুবছর অৰ্থাৎ ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালেও মনোনীত হয়েছিল মহাত্মার নাম। কিন্তু এই সম্মান সেবারও ওঠেনি তাঁর হাতে।
আর তারপর প্রায় এক দশক পর, ১৯৪৭ সালে সম্ভাব্য নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপকদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তবে সেই বছর ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের মধ্যে গান্ধীজিকে পুরস্কার দিতে প্রবল অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন সেই সময়ের নোবেল কমিটির পাঁচ সদস্যের তিনজন।
১৯৪৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার হয়তো পেয়ে যেতেন গান্ধীজি। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখের মাত্র দুই দিন আগে, ৩০ জানুয়ারি মৃত্যু হয় তাঁর। নোবেল কমিটি জানিয়েছিল, গান্ধীজিকে বিজয়ী ঘোষণা করার পর যদি তাঁর মৃত্যু হত, তাহলে তাঁকে মরণোত্তরসেই সম্মান দেওয়া যেত। শুধু তাই নয় বিপত্তির কারণ ছিল আরও একটি। মৃত্যুর আগে কোনও উইল করে যাননি তিনি। তাই পুরস্কার বাবদ পাওয়া গান্ধীজির ওই অর্থ কে পাবেন, তা নিয়ে আর নোবেল পাওয়া হয়নি গান্ধীজির। তবে ওই বছর কাউকেই নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়নি নোবেল কমিটি। তবে মহাত্মা গান্ধীর বাদ পড়াটা যে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ২০১৯ সালে তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন নোবেল কমিটির তৎকালীন সেক্রেটারি লিন্ডস্ট্যান্ড।
Leave a Reply