পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি খাদ্য উপাদানের কথা উঠলে প্রথমেই আসে মধুর নাম। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি এই মধু তৈরির একমাত্র কান্ডারি হল মৌমাছি। দেখতে ছোট্ট হলেও মৌমাছির জীবন জুড়ে রয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। শুনতে অবাক লাগলেও মৌমাছিদের দেহই হল এক একটা মধু তৈরির কারখানা। মৌমাছির পরিশ্রম আর শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপনের ফলে উৎপন্ন এই মধুর স্বাদ গ্রহণ করতে পারছে গোটা মানব জাতি।
আপাতদৃষ্টিতে সবাই ভেবে থাকেন মধুতে শুধু ফুলের রসই থাকে। কিন্তু মধু আসলে ফ্রুক্টোজ, গ্লুকোজ,জল, তেল সহ কিছু বিশেষ ধরনের এনজাইমের মিশ্রণে তৈরি করা হয। যা তৈরী করতে মৌমাছি বিভিন্ন ধাপে ধাপে কাজ করে। কিন্তু আপনি কি জানেন মৌমাছিরা মধু কিভাবে তৈরি করে? আসুন জানা যাক মৌমাছির মধু তৈরির বিভিন্ন ধাপ গুলি সম্পর্কে।
মৌমাছির মধু সংগ্রহ
মধু তৈরির জন্য কর্মী মৌমাছিরা প্রথমেই ফুল থেকে মধু আহরণ করতে বেরিয়ে পড়ে। মধু সংগ্রহের পর তারা সরাসরি পৌঁছে যায় নিজেদের মৌচাকে। কিন্তু কাজটা মোটেই অত সহজ নয়। জানলে অবাক হবেন, মাত্র এক পাউন্ড মধু তৈরি করতে মৌমাছিদের প্রায় ১০ থেকে ২০ লক্ষ ফুলের মধু সংগ্রহ করতে হয়। তাই এমনি এমনিই পরিশ্রমী প্রাণীর তকমা পায়নি মৌমাছি। ফুলের রস আর পরাগই হল মৌমাছির প্রধান খাদ্য। মৌমাছি ফুল থেকে যে রস সংগ্রহ করে সেই রসের মধ্যে থাকে চিনি আর কার্বোহাইড্রেট। জানা যায় এই কার্বোহাইড্রেটটিকেই মৌমাছি নিজেদের শরীরে শক্তি বৃদ্ধির কাজে লাগায়।
মৌমাছির সংগ্রহ করা ফুলের রসই কি মধু?
ঘুরে ঘুরে ফুলের রস সংগ্রহ করে তা থেকে মধু তৈরী করাই মৌমাছির কাজ। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হল মৌমাছি কি সরাসরি ফুল থেকেই মধু সংগ্রহ করে? যে মধু আমরা খাই সেটা কি তাহলে ফুলেরই রস? এককথায় উত্তর হল ‘না’। ফুলের রস আর আমরা যে মধু খাই তার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আসলে ফুলের রস সংগ্রহ করার পর থেকে মধু তৈরি হওয়া পর্যন্ত রয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। মৌচাকের মধ্যেই থাকে মৌমাছিদের বিরাট বড় একটা সাম্রাজ্য। সেখানে একজন রানী মৌমাছি,আর রাজা মৌমাছি ছাড়াও থাকে অসংখ্য কর্মী মৌমাছি। তাছাড়াও থাকে আরও কিছু মৌমাছি যারা মধু তৈরির কাজ করে।
কীভাবে তৈরি হয় মৌচাকের মধ্যে মধু ?
সারাদিন ঘুরে ঘুরে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে আনে কর্মী মৌমাছিরা। কিন্তু শীতকালে বেশি ফুল ফোটে না, তাই গরম কালেই বেশি পরিমাণে ফুলের রস সংগ্রহ করে রাখে তারা। তাই মৌচাকের কর্মী মৌমাছিদের থাকে দুটি পাকস্থলী। যার একটিতে তারা খাবার রাখে আর অন্যটিতে সংগ্রহ করে রাখে ফুলের রস। ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে কর্মী মৌমাছিরা তা মৌচাকের প্রসেসর মৌমাছির মুখে তুলে দেয়। এরপর প্রসেসর মৌমাছির পাকস্থলীর মধ্যেই মধু তৈরির বাকি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।
প্রসেসর মৌমাছির কাজ:
প্রসেসর মৌমাছিরা কর্মী মৌমাছির কাছ থেকে ফুলের রস সংগ্রহ করার পর তার সঙ্গে ইনভার্টেজ নামের এক ধরনের উৎসেচক মিশিয়ে দেয়।
এরপর ফুলের রসের মধ্যে থাকা সুক্রোজকে গ্লুকোজ আর ফ্রুক্টোজে ভেঙে দেয়।
এরফলে যে আংশিক মধু তৈরী হয় তা ওই প্রসেসর মৌমাছিটি অপর একটি প্রসেসর মৌমাছির মুখে তুলে দেয়।
এরপর ওই প্রসেসর মৌমাছি আংশিক মধুতে আরও ইনভার্টেজ উৎসেচক মেশাতে শুরু করে। এই কাজটি চলাকালীন ফুলের রসের ওই মিশ্রণের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে। জলকে বাষ্পীভূত করার কাজটাও করে থাকে মৌমাছিরাই।
এই পর্যায়ে এসে মৌমাছিরা খুব দ্রুত ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। এরফলে তাদের শরীরে থাকা জল ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হয়। এইভাবেই ফুলের রসের মিশ্রণটি ধীরে ধীরে ঘন হয়। এই ভাবেই একেবারে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী হয় সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণসম্পন্ন মধু।
Leave a Reply