সিরাজউদ্দৌলা লুৎফুন্নেসা

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরম সুন্দরী পত্নী ছিলেন লুৎফুন্নেসা। তিনি ছিলেন নবাবের প্রিয়তম তৃতীয় স্ত্রী। তবে বিয়ের আগে তিনি ছিলেন সিরাজের নানীজান শরীফুন্নেছা বেগমের হিন্দু পরিচারিকা। তখন তাঁকে রাজকুনোয়ারি বলে ডাকা হতো। সেসময় লুৎফুন্নেসার সৌন্দর্য এবং ভালো ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়ে সিরাজ তাঁকে নিজের হেফাজতে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন সিরাজের কথা মতোই লুৎফুন্নেসাকে তার সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছিল। তখন যদিও তাঁর নাম লুৎফুন্নেসা হয়নি।

পরবর্তীতে সিরাজ তাঁকে বিয়ে করেছিল এবং ধর্মান্তকরণের পর নাম দিয়েছিলেন লুৎফুন্নেসা বেগম। যদিও তার আগেই দুবার বিয়ে করে ফেলেছিলেন সিরাজ। তাই তখন সিরাজের আরো দুই স্ত্রী ছিলেন। তাঁরা হলেন জায়েবুন্নেছা এবং উমদাতুন্নেছা বেগম। কিন্তু তাঁদের সকলের মধ্যে লুৎফুন্নেসাই ছিলেন সিরাজের সবচেয়ে প্রিয়তমা বেগম।

জানা যায় আলীবর্দী খান নাতি সিরাজকে নিজের তত্ত্বাবধানে রেখেই বড় করে তুলেছিলেন। মাত্র ১৯ বছর  বয়সেই তিনি সিরাজের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে সিরাজের কোন সন্তান ছিল না। তিনি সব সময় আনন্দবিলাসেই মগ্ন থাকতেন। এমনকি সিরাজ এবং লুৎফুন্নেসার ঘনিষ্ঠতাও তাকে কখনোই বিচলিত করেনি। কিছুদিনের মধ্যেই  লুৎফুন্নেসার সৌন্দর্য এবং ভালো ব্যবহার সিরাজের মনে জায়গা করে নেয়। সিরাজের সাথে বিয়ের পরেই  লুৎফুন্নেসার গর্ভেই জন্মায় সিরাজের প্রথম সন্তান জোহরা।

পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের  চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরেই সেই রাতে রাজধানী ফিরে এসেছিলেন সিরাজ। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাবেন এবং সৈন্য সামন্ত প্রস্তুত করে আবার আক্রমণ করবেন মীরজাফর এবং ইংরেজদের ওপর। তখন লুৎফুন্নেসা তাঁকেও সঙ্গে নেওয়া আকুল আবেদন জানান। তখন সিরাজ তাঁকে ফেরাতে পারেননি। তাই বিশ্বস্ত স্ত্রী লুৎফুন্নেসা সহ একমাত্র কন্যা জোহরা এবং কিছু  অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন গভীর রাতে মুর্শিদাবাদ  শহর ত্যাগ করেছিলেন নবাব।

যদিও পালাতে গিয়ে এক ফকিরের নজরে পড়ে গিয়েছিলেন সিরাজ। সেই ফকিরই  কয়েকটি মোহরের লোভে সেই ঘটনা জানিয়ে দিয়েছিলেন মীরজাফরকে। এরপর মিরজাফরের জামাই মীরকাসিম সিরাজকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। তখন মীরকাসিম লুকানো সোনা দানার সন্ধান চেয়ে লুৎফুন্নেসার উপর অত্যাচার শুরু করে। আর তার কিছুদিনের মধ্যেই সিরাজকে অত্যন্ত নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল। সিরাজকে হত্যা করে নবাব হয়েছিলেন মীরজাফর। তাকে নবাব করেছিলেন ক্লাইভ। সিরাজের মৃত্যুর পর সিরাজের বিধবা তরুণী স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগমকে মীরজাফরের পুত্র মীরন বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।  লুৎফুন্নেসা তখন জবাবে তাকে বলেছিল ‘আমি প্রথমে হাতির পিঠে চড়েছি, এখন গাধার পিঠে চড়া সম্ভব নয়।’

তবে জানা যায় সিরাজের মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত আত্মীয়-স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল মীরজাফর পুত্র মীরন। বেঁচে ছিলেন শুধু লুৎফুন্নেসা এবং তার ছোট্ট মেয়ে জোহরা। লুৎফুন্নেসা নিজের সারা জীবন স্বামীর কবরের পাশেই অতিবাহিত করেছেন। আসলে নবাবের চরিত্রের ওপরে লুৎফা বেগমের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। তবে উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী লুৎফা সারা জীবন সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। নবাবের পতনের পর লুৎফুন্নেসা সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।

তিনি খোশবাগে সিরাজের কবরের পাশে একটি কুঁড়েঘর তৈরি করেই কাটিয়েছিলেন বাকি জীবন। জানলে অবাক হবেন এই মহীয়সী নারী সব লোভ,ঐশ্বর্য পরিত্যাগ করে জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়ে দিয়েছেন প্রাণাধিক প্রিয় স্বামী সিরাজের ধ্যানে। তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর এভাবে স্বামীর সেবা করে ১৭৯০ সালের নভেম্বর মাসে পরলোক গমন করেন এবং মুর্শিদাবাদে সিরাজের পদতলে তিনি সমাধিস্থ হন।   ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লুৎফুন্নেসা এবং তার কন্যার ভরণপোষণের জন্য মাসিক ৬০০ টাকা করে বরাদ্দ করেছিলেন। ক্লাইভের নির্দেশেই লুৎফুন্নেসা এবং তার কন্যা জোহরাকে মুর্শিদাবাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁর এই নির্দেশের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না খোদ মীরজাফরেরও। সেই সময় তিনি যে মাসোয়ারা পেতেন তা দিয়েই প্রতিদিন কাঙালি ভোজনের ব্যবস্থাও করতেন। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং লুৎফুন্নেসার প্রেম কাহিনী অমর হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *