মা কালীর মাহাত্ম হিন্দু ধর্মে অবিস্মরণীয়। বহু হিন্দু ধর্মগ্রন্থ এবং পুরাণের সাথে জড়িয়ে রয়েছেন এই দেবী। মা কালীর মতো রহস্যময়ী প্রচন্ড ভয়ংকর অথচ অদ্ভুত সুন্দর দেবী আর কেউ নেই। তাই তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। পুরান মতে শিবের তাণ্ডব নৃত্যের কথা কমবেশি সকলেরই জানা। দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মা কালীর জাগ্রত সতীপীঠ গুলির মধ্যে অন্যতম হল আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের কাছে অবস্থিত ‘তারাপীঠ’। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী এই মন্দির ও শ্মশান একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। হিন্দু পুরাণ মতে যা ৫১ টি সতী পিঠের মধ্যে অন্যতম। তারাপীঠ এখানকার পাগলা সন্ন্যাসী বামাক্ষ্যাপার জন্যও বেশ বিখ্যাত। তিনি নিয়মিত এই মন্দিরে পূজা করতেন এবং মন্দির সংলগ্ন শ্মশান ক্ষেত্রে কৈলাসপতি বাবা নামে এক তান্ত্রিকের কাছে তন্ত্রসাধনা করতেন। তারাপীঠ বীরভূম জেলার মারগ্রাম থানার সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি ছোটো গ্রাম। রামপুরহাট ও চাকপাড়ার ‘তারাপীঠ রোড’ এই তীর্থক্ষেত্রের নিকটতম রেল স্টেশন। তারাপীঠ মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে একাধিক কিংবদন্তী।
শক্তিপীঠ এই ধারণাটির সাথে জড়িয়ে এক জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনী। মহাদেবের স্ত্রী সতী তাঁর পিতা দক্ষের ‘শিবহীন যজ্ঞ’ দেখে প্রচন্ড ক্রোধে অপমানে স্বামীনিন্দা সহ্য করতে না পেরে যোগ্য স্থলেই আত্মহুতি দিয়েছিলেন। তখন এই ঘটনায় প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে শিব সতীর দেহ নিয়ে কাঁধে নিয়েই তান্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন। তখন ভগবান বিষ্ণু মহাদেবকে শান্ত করতে তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়েই সতীর দেহ খন্ড-বিখন্ড করে দিয়েছিলেন।
তখন সতীর দেহ ৫১ টি খন্ডে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে পড়েছিল। যা পরবর্তীতে শক্তিপীঠ নামে পরিচিত হয়। পশ্চিমবঙ্গেও রয়েছে এমনই একাধিক শক্তিপীঠ। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পীঠ হল কালীঘাট আর তারাপীঠ। কথিত আছে সতীর তৃতীয় নয়ন বা নয়নতারা তারাপুর বা তারাপীঠ গ্রামে পড়েছিল। যা পরে প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। ঋষি বশিষ্ঠই নাকি প্রথম এই রূপটি দেখতে পেয়েছিলেন আর তিনিই সতীকে তারা রূপে পুজো করা শুরু করেছিলেন। সেই থেকেই দ্বারকা নদীর পুব পাড়ের চণ্ডীপুর আজ তারাপীঠ।
কথিত আছে, সাধক বশিষ্ঠ দ্বারকার কুলে মহাশ্মশানের শ্বেত শিমূলের তলে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তারামায়ের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। তবে, সে দিনের শিমূল গাছ আজ আর নেই। খরস্রোতা দ্বারকাও আজ পরিণত হয়েছে নোংরা খাল। জনারণ্যে হারিয়ে গেছে মহাশ্মশানের ভয়াবহতা। ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠর সিদ্ধপীঠ এই তারাপীঠ আরও অনেকেরই সাধনপীঠ –- তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাধক বামাক্ষ্যাপা।
কথিত আছে সাধক বশিষ্ঠ দ্বারকার কূলে মহাশ্মশানের শ্বেত শিমূলের তলে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তারা মায়ের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। যদিও সেই শিমুল গাছ কিংবা খরস্রোতা দ্বারকা আজ আর নেই। তারাপীঠ মন্দিরের বর্তমান ইতিহাস প্রায় ২০০ বছর পুরনো হলেও তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে দেড় হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ইতিহাস। জানা যায় তারাপীঠের বর্তমান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মল্লারপুরের এক জমিদার। যদিও তারও আগের ইতিহাস ঘাঁটলে উঠে আসে সওদাগর জয়দত্তের কাহিনী। তাঁকে নাকি মা স্বয়ং এসে কুমারী মেয়ে রূপে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন পুত্র শোকে কাতর জয়দত্ত মা’কে চিনতে পারেননি। তবে পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি দেবীর দর্শন লাভের জন্য কাতর প্রার্থনা করেছিলেন। তখন স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবীর আশীর্বাদেই ওই সওদাগর ফিরে পেয়েছিলেন নিজের মৃত সন্তান আর সমস্ত ধন সম্পত্তি। তাই তিনি মায়ের আদেশে পরবর্তীতে মায়ের স্বপ্নাদেশ মেনেই বশিষ্ঠকুণ্ড বা জীবিতকুণ্ডের সামনে শিলা মূর্তি ও চন্দ্রচূড় শিবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এ ছাড়া কেনই বা এখানকার দেবীর নাম তারা হল, তাই নিয়েও প্রচলিত আছে পুরাণের এক কাহিনি। হিন্দু পুরাণ মতে সমুদ্রমন্থনে ওঠা বিষ পান করেই শিব হয়ে উঠেছিলেন নীলকণ্ঠ। বিষে জর্জরিত শিবকে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে স্বর্গলোকের সব দেবতা তখন ‘দেবী তারার’ কাছে গিয়ে প্রার্থনা করেন শিবকে গরলমুক্ত করতে। তখন ‘দেবী তারা’ শিবকে সন্তানের মতো কোলে নিয়ে স্তন্য পান করিয়েছিলেন। সেই অমৃত পান করেই শিবের বিষজ্বালা দূর হয়। তিনি যেভাবে শিবকে তারণ করেছেন।সেই একইভাবে গোটা বিশ্বকেও তারণ করছেন তিনি। সেই থেকেই দেবীর নাম হয় তারিণী। পরে এই তারিণী নাম থেকেই সৃষ্টি হয় তারা নামের।
Leave a Reply