বাঙালি মানেই পায়ের তলায় সর্ষে! আর এই ভ্রমণ পিপাসু বাঙালির সর্বক্ষণ ‘উঠল বাই তো কটক নয় দীঘা যাই’ অবস্থা। সমুদ্রের ওই উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করতে পারে না কেউই। তাই সুযোগ পেলেই এখন বছরে মানুষ প্রায় তিন চারবার করে দীঘা ঘুরেই আসে। তাই দীঘায় আমরা অনেকেই অনেকবার গিয়েছি। কিন্তু জানেন কি পরাধীন ভারতের গন্ধমাখা এই দীঘাই একসময় ব্রিটিশ শাসকদেরও প্রিয় ভ্রমণস্থল ছিল। তবে জানলে অবাক হবেন ইংরেজ আমলে এই সৈকত সুন্দরীর নাম কিন্তু দীঘা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এই সৈকত শহরের নাম হয়েছে দীঘা। তাহলে কি ছিল দীঘার আসল নাম? এখন শুনলে হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করবেন না কিন্তু সেই সময় পূর্ব মেদিনীপুরের এই সৈকত শহরটির নাম ছিল বীরকুল।
জানা যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ অফিসাররা নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেই হাওয়া বদলের জন্য আসতেন এই সমুদ্রসৈকতে। ইতিহাসের পাতা উল্টে জানা যায় এমনই সময় ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশা উপকূলকে লিজ নেওয়ায় ব্যর্থ হন বাংলার তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস। সেই সময় তাঁর নজর গিয়ে পড়ে দক্ষিণ পশ্চিম মেদিনীপুরের ওড়িশা সীমান্ত লাগোয়া উপকূল অঞ্চল বীরকুলের ওপর। জানা যায় ১৭৭৫ সালে হেস্টিংস বীরকুলের মনোরম সমুদ্র সৈকতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটানোর জন্য একটি বাংলো তৈরি করেছিলেন। তৎকালীন এই বীরকুলের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশই ছিল ব্রিটিশ শাসকদের সমুদ্রস্নান কিংবা মাছ ধরা সহ বিনোদনের অন্যতম উপযুক্ত একটি জায়গা। এই কারণেই সেইসময় বীরকুলের সমুদ্র সৈকতে বিশ্রামাগার তৈরির পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৭৭৮ সাল নাগাদ তৎকালীন ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর পাতায় সেই পরিকল্পনার কথা উল্লেখও করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে ১৭৮০ সাল নাগাদ এই সৈকত সুন্দরীতে ঘুরতে এসে নিজের স্ত্রীকে লেখা একটি চিঠিতে বীরকুলকে ‘ব্রাইটন অফ ক্যালকাটা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। এরপর অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ কোম্পানির আধিকারিকরা এই সমুদ্র উপকূলে এসেই সস্ত্রীক ছাউনি ফেলতেন। যদিও পরবর্তীকালে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আর ভূমিক্ষয়ের ফলে বীরকুল ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছিল। এমনকি হেস্টিংস সাহেবের সাধের বাংলো বাড়িটিও সেসময় সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
এরপর মাঝখানে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। তখন বীরকূল ছিল পরিচয়হীন দুর্গম গ্রাম। এমন সময় ১৯২৩ সালে কলকাতার জুয়েলারি ও ঘড়ি তৈরির প্রসিদ্ধ হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানির মালিক জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেইথ পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে আর রামনগরের এক বাসিন্দার কাছে তখনকার বীরকুলের এই সমুদ্র সৈকতের কথা জানতে পারেন। সে সময় যদিও তিনি নেহাত কৌতুহল বশতই হাতির পিঠে চেপে বীরকুলের সমুদ্র সৈকতে এসেছিলেন। সেসময় এই সৈকত সুন্দরীর সৌন্দর্যে তিনি এতটাই মোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে সে সময় তিনি সমুদ্র পাড়ে ১১.৫ একর জমি লিজ পেয়ে সেখানেই তৈরি করেন রানসউইক হাউস
এরপর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়কে দীঘায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেইথ। এরপর ১৯৫০ সালে দীঘায় গড়ে ওঠে পর্যটন কেন্দ্র এবং ধীরে ধীরে তৈরি হয় সৈকতাবাস, জল সরবরাহ-সহ নানা ব্যবস্থা। আর এই ভাবেই ধাপে ধাপে বীরকুল পরিণত হয় এখনকার দীঘায়।
Leave a Reply