যৌনপল্লী নামটা শুনলেই ভ্রু কুঁচকে থাকেন অনেকে। একই ছবি ধরা পড়ে কলকাতার সোনাগাছির নাম শুনলেও। আসলে নামটা যেহেতু নিষিদ্ধ যৌনপল্লীর তাই মানুষের অস্বস্তিতে পড়াটা খানিকটা স্বাভাবিক। উত্তর কলকাতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এই জায়গাটির আসল নাম
গৌরীশংকর লেন হলেও তা এখন সকলের কাছে পরিচিত সোনাগাছি নামেই। কলকাতা শহর হয়ে ওঠার অনেক আগেই গড়ে উঠেছিল এখনকার ‘সোনাগাছি’ নামে পরিচিত এই যৌনপল্লি।
জানা যায় এই জায়গাটির জমিদার ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তার তত্ত্বাবধানেই জায়গাটি যৌনপল্লীর রূপ নিয়েছিল। প্রসঙ্গত ১৮ থেকে ১৯ শতকের সময় কলকাতায় প্রচলন ছিল বাবু কালচারের। সে সময় কলকাতার পয়সাওয়ালা,অভিজাত পরিবারের বাঙালি বাবুদের বিবাহিত স্ত্রী ছাড়াও থাকতো বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। কিন্তু তাদের ঘরের বউদের সাথে রাখা উচিত হবে না ভেবেই এই এলাকাতেই আলাদা বাড়ি বানিয়ে সেখানেই রাখতেন উপপত্নীদেরর। আর এসবের বিনিময়ে এই রক্ষিতা দের তারা নিয়মিত টাকা-পয়সা দিয়ে আদর যত্নে মুড়ে রাখতেন। সেসময় বাবুদের বারবণিতা বিলাস নাকি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। সেই এলাকাই বর্তমানের সোনাগাছি।
একসময় হুগলি নদী এবং পার্শ্ববর্তী সুতানটীর হাট ছিল এই এলাকার অন্যতম একটি বড় ব্যবসা কেন্দ্র। ইংরেজি আমলে চিৎপুর রোড নামে পরিচিত এই এলাকাতেই সে সময় যাতায়াত ছিল তীর্থযাত্রীদের। তাই সেইসমস্ত ব্যবসায়ী মানুষজন আর তীর্থযাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য ধীরে ধীরে এই এলাকা পরিণত যৌনপল্লিতে।
এছাড়া এই সোনাগাছিতে পা পড়েছিল বহু ব্রিটিশদেরও। ইংরেজ আমলে প্রচুর সংখ্যক কম বয়সি ইংরেজ সৈন্যদের আনা হয়েছিল বাংলায়। পকেট ভারী হলেও তাঁদের বউ বাচ্চারা থাকতো বিদেশে। তাই নিজেদের চাহিদা মেটাতে তখন তারা এই অঞ্চলের রক্ষিতা বা উপপত্নীদের সাথে কিংবা কম বয়সী বিধবা মেয়েদের সাথে অল্প টাকার বিনিময়ে শারীরিক সম্পর্ক রাখতেন। তাদের হাত ধরেই টাকার বিনিময়ে এই এলাকায় প্রথম শুরু হয়েছিল দেহব্যবসা।
বর্তমানে এলাকাটি ‘সোনাগাছি’ নামে পরিচিত হলেও আদতে শব্দটা ছিল ‘সোনাগাজি’। এই নামটা এসেছে সোনাউল্লা নামে এক ইসলাম ধর্ম প্রচারকের নামে তৈরি এক মসজিদ থেকে। কলকাতার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় এই সোনা গাজির পুরো নাম ছিল সোনাউল্লা শাহ চুস্তি রহমতুল্লা আলে। শোনা যায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করতেই তিনি নাকি ইরান থেকে ভারতে এসেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। সারা জীবন খুন-জখম-ডাকাতি-রাহাজানির মতো দুষ্কর্ম করেছিলেন তিনি। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী মৃত্যুর পর তিনি তাঁর মায়ের স্বপ্নে এসে বলেছিলেন তিনি এবার সব মানুষের উপকার করবেন। তাঁর নামেই তাঁর ওই এলাকায় একটি ছোট মসজিদ তৈরী করেছিলেন। ওই এলাকায় নাকি এখনো নাকি সেই মসজিদ দেখা যায়। এই সোনাগাজীর মৃত্যুর পর তার নাম অনুসারেই এলাকার নাম হয় সোনাগাজী, পরে তা লোকমুখে ঘুরে ঘুরে ‘সোনাগাছি’তে পরিণত হয়।
Leave a Reply