আমরা জানি পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতবর্ষ। কিন্তু জানলে অবাক হবেন আমাদের এই দেশের মধ্যেই রয়েছে এক ‘বিশ্বগ্রাম’ বা ‘ইউনিভার্সাল সিটি’ যেখানকার মানুষদের জীবনের মূল মন্ত্রই হল ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’। দক্ষিণ ভারতের অরোভিল নামের এই শহরটিতে থাকা-খাওয়া জন্য খরচ হয় না এক পয়সাও। শুধুই কি তাই! এছাড়াও এখানে নেই কোন সরকার,নেই কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম। শুধু রয়েছে এই শহরের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম। এই শহরে থাকার জন্য রয়েছে শুধু একটাই শর্ত, তা হল আপনাকে এখানে সেবক হিসেবে থাকতে হবে। এই শর্ট মেনে চললেই যে কেউ থাকতে পারেন এই শহরে .
চেন্নাই থেকে ১৫০কিলোমিটার এবং পুদুচেরি থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ছোট্ট নগর অরোভিল। কোনো ধর্ম-বর্ণ কিংবা ভাষার ভেদাভেদ নেই এখানে। নেই কোনো বিশৃঙ্খলাও। এখানকার বাসিন্দারা তাঁদের কিছু নিয়ম-কানুন মেনেই বসবাস করেন এই স্বপ্নের শহরটিতে। যা অনেকের কাছে ‘সিটি অফ ডন’ বা ‘সান অফ ডন’ নামেও পরিচিত। বৈষম্যহীন সমাজ স্থাপনের উদ্দেশ্যেই ১৯৬৮ সালে এই শহরের পত্তন করেছিলেন মিরা আলফাজোস। যিনি বাঙালির কাছে পরিচিত শ্রীমা নামে। তার আগেই পন্ডিচেরিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্রী অরবিন্দ আশ্রম। বাংলার অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবী ঋষি অরবিন্দ ঘোষের সমাধি আজও রাখা রয়েছে এই ঋষি অরবিন্দ আশ্রমে। যা ছুঁলে আজও সারা শরীর দিয়ে বয়ে যায় এক অদ্ভুত অনুভূতি। এমনটাই মনে করেন অনেকে।
ঋষি অরবিন্দের আদর্শকে ছড়িয়ে দিতেই তৈরি হয়েছিল এই অরোভিল। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে তৈরি হয়েছিল এক বিশাল অরবিন্দ চর্চা কেন্দ্র। অরবিন্দময় পুদুচেরিতে অবস্থিত এই অরবিন্দ আশ্রমেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর নানান কর্মকাণ্ডের নিদর্শন। এখান থেকেই ঢিল ছোঁড়া দূরেই রয়েছে বিশ্বগ্রাম অরোভিল। এই গ্রামেই রয়েছে গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের বাস। বহু ভাষা-ধর্ম-বর্ণের মানুষের এক অদ্ভুত মিলন স্থান এই শহর। ইউনিভার্সাল এই সিটিতে যে কেউ এসে বসতি স্থাপন করতে পারেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জানা যায় প্রায় ৫০ টি দেশের মানুষ এখানে বসবাস করেন।এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় ২৪০০০। যা না দেখলে ভারতের অর্ধেকটাই অজানা থেকে যাবে ভারতীয়দের কাছেই।
আগেই বলেছি অরোভিললে নেই কোন সরকার। তাই এই শহর প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সমাবেশ দ্বারা পরিচালিত হয়। সদস্যদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিভিন্ন জাতির মানুষ। তারপরেও এখানে নেই কোন বিশৃঙ্খলা। ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে সত্যের পথ অনুসরণ করে চলেন এই শহরের মানুষ। শহরের মাঝেই রয়েছে একটি মন্দির যাকে বলা হয় মাতৃমন্দির। এই শহরে নগদ অর্থ প্রদানের প্রচলন নেই। এখানে কাগজের মুদ্রার বিনিময় করা হয়ে থাকে।তবে বহিরাগতদের সঙ্গে অর্থ বিনিময় করা হয়। জানা যায় ৩৫ বছর আগে এক আর্থিক পরিষেবা কেন্দ্র চালু হয়েছিল এই শহরে। এই কেন্দ্রটিকে মানুষ ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেন। এখানকার বাসিন্দারা এই ব্যাঙ্কে অফলাইন এবং অনলাইনে টাকা জমা দেন।
এই শহরের নিজস্ব স্থাপত্য এবং শহর পরিকল্পনা ব্যুরো ছাড়াও রয়েছে হাসপাতাল,বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, অডিটোরিয়াম, গেস্টহাউস,রেস্তোঁরা,৪০টি ইন্ডাস্ট্রি , খামার, ইত্যাদি। বাসিন্দাদের জন্য রয়েছে একটি কম্পিউটার, একটি ই-মেইল নেটওয়ার্ক (ওরনেট)।অরোভিলে যাওয়ার জন্য নিকটতম বিমান বন্দর হল চেন্নাই। যা শহর থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শহরটি ভারতের প্রধান শহরগুলি সাথে ভালোভাবে সংযুক্ত। ট্রেনে যাওয়ার জন্য এই শহরের নিকটতম রেল স্টেশন হল ৩২ কিমি দূরে অবস্থিত ভিলুপুরম। এছাড়া হাওড়া থেকে পুদুচেরি স্টেশন গিয়ে কেউ চাইলে অরবিন্দ আশ্রমে এক দিন ঘুরে সেখান থেকেই প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অরোভিলে যেতে পারেন।
Leave a Reply