আমাদের দেশের বৃহত্তম গণ পরিবহন ব্যাবস্থার কথা উঠলে প্রথমেই আসে ভারতীয় রেলের কথা। নিত্যযাত্রীদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে হোক কিংবা ভ্রমণ পিপাসুদের দূরদূরান্তে ভ্রমণের ক্ষেত্রে হোক দ্রুত, কম খরচে গন্তব্যস্থলে জন্য সকলেরই ভরসা ভারতীয় রেল। তাই দূরপাল্লার ট্রেনে যারা উঠেছেন তারা সকলে নিশ্চই ট্রেনে থাকা শৌচাগার লক্ষ্য করেছেন বহুবার। কিন্তু ট্রেনের মধ্যে এই শৌচাগার তৈরির ধারণা এল কিভাবে? তা হয়তো জানা নেই অনেকেরই।
সকলেই জানেন পরাধীন ভারতে প্রথম রেল পরিষেবা চালু হয়েছিল ইংরেজদের হাত ধরেই। ১৮৫৩ সালে, ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল হার্ডিঞ্জের সময়েই প্রথম চালু হয়েছিল রেল পরিষেবা। কিন্তু সে সময় ট্রেনের নিচু শ্রেণির যাত্রীদের জন্য দূরপাল্লার ট্রেনে কোন শৌচালয়ের ব্যবস্থা ছিল না। প্যাসেঞ্জার ট্রেনের যাত্রীদের প্রতি এই বৈষম্য নিয়েই কেটে যায় ৫৫ বছর। কারণ তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের মনে হয়েছিল যাত্রীরা ৫০ মাইলের বেশি যাত্রা করবেন না, তাই এক্ষেত্রে শৌচালয় করার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু ব্রিটিশদের এই ধারণায় সমূলে আঘাত হেনেছিলেন একজন সাধারণ বাঙালি। তিনি হলেন শ্রী অখিল চন্দ্র সেন। ট্রেনের গার্ডের প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভের বশে তাঁর করা আবেদনেই রাতারাতি নড়েচড়ে বসেছিল রেল কর্তৃপক্ষ। মূলত তাঁর কলমের জোরেই ১৯১০ সাল নাগাদ ট্রেনে সবার জন্য শৌচাগারের বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হয়েছিল রেল কর্তৃপক্ষ। তাই তাঁর লেখা চিঠি নয়াদিল্লির রেলওয়ে মিউজিয়ামে জ্বলজ্বল করছে আজও।
নেপথ্যের কারণ:
সালটা ছিল ১৯০৯। সে সময় ট্রেনে ওঠার আগে স্ত্রীর সাথে গল্প করতে করতেই খানিকটা বেশি পাকা কাঁঠাল খেয়ে ফেলেছিলেন অখিল বাবু। খাওয়া-দাওয়ার পর ট্রেনে উঠে বেশ কিছুদূর যেতেই শুরু হয় তাঁর পেটে ব্যথা। এরপর তাঁর আশঙ্কাকে সত্যি করেই পেটের ব্যাথা বেড়ে যায় আরও কয়েকগুণ। কিন্তু ট্রেনে তখন কোনও শৌচালয়ও ছিল না! তাই সময় নষ্ট না করে পরের স্টেশন আহমেদপুরেই নেমে পড়েন তিনি। এরপর স্টেশনের শৌচালয়ে তাঁর শৌচকর্ম সারতে সারতেই ট্রেনের গার্ড হুইসেল বাজিয়ে দেন। তখন কুলকিনারা না পেয়ে ওই পরিস্থিতিতেই এক হাতে লোটা আর এক হাতে ধুতি ধরে ছুটলেন ট্রেন ধরার জন্য। কিন্তু তাঁর সামনে দিয়ে ট্রেন তো চলে গিয়েইছিল আর সেইসাথে তিনি নিজেও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন প্ল্যাটফর্মের উপর। আর ত্বকে ওই অবস্থায় দেখে প্ল্যাটফর্মের লোকজন খুব হাসাহাসি করেছিল। সেদিন খুব অপমানিত হয়েছিলেন অখিলেশ বাবু। আর তাঁর রোষের মুখে পড়েন ট্রেনের গার্ড। এই পরিস্থিতির একটা বিহিত করতে বাড়ি ফিরেই সাহেবগঞ্জের ডিভিশনাল অফিসারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি।
এই পর্যন্ত পড়ে সবারই নিশ্চই জানার কৌতূহল হচ্ছে ওই চিঠিতে অখিলেশ বাবু কি এমন এমন লিখেছিলেন? ইংরেজিতে লেখা অখিলেশ বাবুর সেই যুগান্তকারী চিঠির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় –
‘আমি আহমেদপুর স্টেশনে পৌঁছলাম। কাঁঠাল খাওয়ার জন্য আমরা পেট ফুলতে শুরু করে। স্টেশনে নেমে শৌচকর্ম করতে যাই। কাজ শেষ করে উঠতে যাব, তখনি গার্ড ট্রেন ছাড়ার জন্য বাঁশি বাজালেন। এক হাতে লোটা অন্য হাতে ধুতি ধরে ট্রেন ধরার জন্য ছুট লাগালাম। আমি পড়ে গেলাম। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ ও মহিলারা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। আহমেদপুর স্টেশনেই আমাকে অপেক্ষা করতে হল। এটা খুব খারাপ বিষয় হয়েছে। যদি কোনও যাত্রী শৌচকর্মের জন্য যায়, কয়েক মিনিট ট্রেনটাকে দাঁড় করাতে পারল না গার্ড? এই কারণেই আপনার কাছে আমার অনুরোধ ওই গার্ডের জরিমানা করা হোক, নাহলে এই খবরটা খবরের কাগজে দিয়ে দেব।’
Leave a Reply