টি সিরিজ

মানুষের সময় এবং পরিস্থিতি কখন কীভাবে বদলে যায় তা সত্যিই বলা মুশকিল। ভারতের সবচেয়ে বড় মিউজিক প্রোডাকশন হাউজ টি সিরিজের উত্থানটাও ঠিক তেমনই। যাকে বলে একেবারে স্বপ্নের মতো। গুলশন কুমারের টি-সিরিজের হাত ধরেই একসময় খুলে গিয়েছিল ভারতীয় সঙ্গীত জগতের নতুন দিশা। তাঁর এই প্রোডাকশন হাউজের তরফ থেকেই ব্রেক পেয়েছেন বহু নতুন শিল্পী। দিল্লির রাস্তায় ফলের রস বিক্রেতা থেকেই পরবর্তীতে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের একছত্র অধীশ্বর। কিন্তু কীভাবে? সেই গল্পই আজ শোনাবো আপনাদের।

পরিবারের হাল ধরতে মাত্র ২৭ বছর বয়সেই বাবার মতোই দিল্লির রাস্তায় ফল বিক্রি শুরু করেছিলেন গুলশন কুমার। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গুলশন কুমার নতুন কিছু করার তাগিদ আর বেশি অর্থ উপার্জনের ইচ্ছা থেকেই ফল বিক্রির পরবর্তে ফল নিয়েই শুরু করলেন নতুন ব্যবসা। ধার দেনা করে ফলের রস তৈরীর মেশিন কিনে শুরু করেন ফলের রস বিক্রির ব্যাবসা। যা তখনকার দিনে রাজধানী দিল্লির বুকে দারুন ব্যবসা করেছিল।

কিন্তু গুলশন কুমারের মাথায় সবসময় ব্যবসা করার নতুন নতুন আইডিয়া ঘুরতো। তাই যখন তিনি বুঝতে পারলেন ফলের রস তৈরীর ব্যবসা তাঁর পক্ষে বেশীদিন করা সম্ভব নয় তখন একেবারে নতুন এক ব্যবসা করার ঝুঁকি নিয়ে ফেলেন তিনি। সালটা ছিল ১৯৮৩। ওই বছরেই ভারতের সঙ্গীত জগতে আত্মপ্রকাশ করে সুপার ক্যাসেটস ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড। গ্রামোফোন পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের সাধ্যের কথা ভেবেই বাজারে আসে ক্যাসেট প্লেয়ার। সেসময় আরও এক দুর্দান্ত বিজনেস আইডিয়া নিয়ে আসলেন গুলশন কুমার। তাই কপিরাইট আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলেই বড় শিল্পীদের গাওয়া গানের ডুপ্লিকেট কপি বার করলেন তিনি। এরফলে সবাই কম দামেই ক্যাসেট কিনতে শুরু করলেন। আর ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করে সুপার ক্যাসেট কোম্পানি।

কিন্তু দেশের তৎকালীন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে বড় দুই কোম্পানি মিউজিক ইন্ডিয়া এবং পলিডরের ধারে কাছেও সেসময় দাঁড়াতে পারেনি গুলশন কুমার। যার ফলে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়ে তাঁর মিউজিক কোম্পানি। এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতেও বার করে ফেললেন আরও এক নতুন উপায়। নতুন বিজনেস মডেল এনে খুচরো বিক্রেতাদের সুবিধার্থে গুলশন কুমার জানালেন তার প্রোডাকশনের কোন ড্যামেজ ক্যাসেট বা যেগুলো ক্রেতারা বিক্রি করতে পারছেন না এমন ক্যাসেট তারা ফেরত দিতে পারবেন।পরিবর্তে তারা তাদের দামও পেয়ে যাবেন। এর ফলে সমস্ত ক্যাসেট ব্যবসায়ীরাই গুলশান কুমারের কাছে ক্যাসেট বিক্রি করা শুরু করে দিলেন।

সে সময় কোন বড় বড় শিল্পীদের গান মুক্তি পাওয়ার তিন বছর পর তা নতুন আঙ্গিকে তৈরি করা যেত । তাই সেই সময় গুলশান কুমারের টি-সিরিজ লতা মঙ্গেশকর এবং আশা ভোঁসলের গাওয়া গানগুলিকে নতুন শিল্পীদের দিয়ে রেকর্ড করিয়ে নতুন করে বাজারে ছাড়তে শুরু করলেন। সে সময়ের সকল বয়সের সঙ্গীত প্রেমীরা দারুন পছন্দ করতেও শুরু করেছিলেন ভিন্ন স্বাদের সেই গান।

এরপর ১৯৮৮ সালে আমির খান এবং জুহি চাওলা অভিনীত ‘কেয়ামাত সে কেয়ামাত তাক’ সিনেমার মিউজিক লেভেলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গুলশান কুমারের টি-সিরিজের ওপর। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি এই মিউজিক প্রোডাকশন হাউজকে। তবে ১৯৯৭ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে দাউদ ঘনিষ্ঠ মুম্বাইয়ের কুখ্যাত ডন আবু সালেমের গুলিতে প্রাণ হারান গুলশন কুমার।মন্দিরের সামনেই ১৬ রাউন্ড গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।

এরপর টি-সিরিজের দায়িত্ব এসে পড়ে গুলশন কুমারের ছেলে ভূষণ কুমারের কাঁধে। তিনিও ছিলেন তাঁর বাবার মতোই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তিনিও তাঁর বাবার মতোই আগেই বুঝতে পেরেছিলেন সময় আসার আগে পরিবর্তিত রুচি আর শখের সাথে সাথে নিজেদের পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তাই ক্যাসেটের জামানা শেষ হতেই টি-সিরিজকে রীতিমতো একটি মিউজিক প্রোডাকশন হাউজে রুপান্তরিত করে ফেললেন তিনি। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে টি-সিরিজের।


Posted

in

by

Tags:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *