এই মুহূর্তে আলোচনার শিরোমণি, বিজেপি বিরোধী জোট ইণ্ডিয়া। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোটের বদলে ২৬টি মোদী বিরোধী দল নিয়ে গঠিত হয়েছে এই জোট। কেন দেশের নামের সাথে মিল রেখে বিরোধী জোটের নাম সেই নিয়েই উত্তপ্ত রাজ রাজনীতির অন্দর মহল।
খুব চর্চা ছিল শিরোমণি অকালি দল মঙ্গলবার ফের এনডিএ-তে (NDA) যোগ দেবে। দলের নেতা সুখবিন্দর সিংহের সঙ্গে দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বৈঠকও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার দিল্লিতে এনডিএ-র মহা-বৈঠকে যোগ দেননি অকালি নেতারা।
জোর জল্পনা ছিল বেঙ্গালুরুতে যখন বিরোধী দলগুলির বৈঠক চলবে তখন কর্নাটকের জনতা দল সেকুলারের নেতা তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া উপস্থিত থাকবেন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাশের আসনে।
দেবগৌড়া নিজে এনডিএ-তে যোগদানে একশো শতাংশ রাজি থাকলেও তাঁর পুত্র প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচডি কুমারস্বামী এখনই গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে হাত মেলাতে নারাজ। আশ্চর্যের হল, কংগ্রেসও তাদের প্রাক্তন জোট সঙ্গীকে তাদের নিজের রাজ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ডাকেনি।
যদিও একটি সূত্রের খবর, দেবগৌড়া দিল্লির বিমান ধরতে তৈরি হয়ে ছিলেন। কিন্তু বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার আমন্ত্রণপত্র বা ফোন কোনওটাই পাননি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।
তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাও বিজেপি বিরোধী জোট (alliance) গঠনে তুমুল দৌড়ঝাঁপ করেও কোনও দলের মন কাড়তে পারেননি। শেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে নিজের সরকার বাঁচাতে হায়দরাবাদেই বেশি সময় দিচ্ছেন। বেঙ্গালুরুর বিরোধী বৈঠকেও ডাক পাননি তিনি। কারণ, কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি বিরোধী জোটে থাকবেন না, এই সিদ্ধান্তে অনড় তিনি। ফলে কংগ্রেস তাঁকে আমন্ত্রণও জানায়নি। আসলে তেলেঙ্গানার আসন্ন বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ও বিজেপি, দু-দলই তাঁর সমান প্রতিপক্ষ।
মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দল, জগন মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস, আসাউদ্দিন ওয়েইসির এআইএমআইএম ইত্যাদি আঞ্চলিক নয়টি দল আছে যারা মঙ্গলবার বেঙ্গুলুরু ও দিল্লি, দেশের দুই প্রান্তে অনুষ্ঠিত দুটি জোটের বৈঠকের কোনওটিতেই হাজির ছিল না।
প্রশ্ন হল, এই দলগুলি আগামী লোকসভা নির্বাচনে কী ভূমিকা নেবে? তার আগে আগামীকাল থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদের বাদল অধিবেশনেও এই নয় দলের ভূমিকার দিকে নজর থাকবে রাজনৈতিক মহলের। এই অধিবেশনেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল পেশ করার কথা মোদী সরকারের। সেই বিল নিয়ে একমাত্র বিজু জনতা দল বাদে এই নয় দলের আর কোনও পার্টির সরকারের পাশে থাকার কথা নয়।
বিজু জনতা দল এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেস কোনও জোটে না থেকেও সংসদে নানা ইস্যুতে সরকারের পাশে থেকেছে। তা সত্ত্বেও নবীন পট্টনায়েককে বিরোধী জোটে আনতে ভুবনেশ্বরে গিয়ে বৈঠক করেছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। নবীনকে রাজি করাতে পারেননি নীতীশ। বিজু জনতা দল নির্জোট হিসাবেই থাকবে, জানিয়ে দিয়েছেন নবীন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল তাঁর দল সমর্থন করে বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন নবীন।
অন্যদিকে, নানা ইস্যুতে বিজেপির পাশে থাকা জগনমোহন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল সমর্থন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বস্তুত এই প্রশ্নে মতভেদ আছে দুই শিবিরেই। ইন্ডিয়া জোটে থাকা উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা যেমন ওই বিধির পক্ষে। মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব তাই কৌশলে এড়িয়ে যান কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে। বৈঠকে মণিপুর নিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হলেও দেওয়ানি বিধি নিয়ে আলোচনাই হয়নি।
উত্তর প্রদেশে বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়া মায়াবতী তাঁর বহুজন সমাজ পার্টির পুনরুজ্জীবনে জোর দিয়েছেন। তিনি দৌড়ঝাঁপও বাড়িয়ে দিয়েছেন। বেঙ্গালুরু এবং দিল্লি, কোনও বৈঠকেই ডাক পাননি তিনি। বিগত বেশ কয়েক বছর তীব্র কংগ্রেস বিরোধিতার পথে হেঁটে বহেনজি বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ বাকি বিরোধীদের। কিন্তু এখন তাঁর দলেরই অস্তিত্ব সংকট। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে সরব হয়েছেন তিনিও। রাজনৈতিক মহলের মতে, দুর্নীতির গুচ্ছ মামলায় ফেঁসে থাকা মায়াবতীর পক্ষে খুল্লামখুল্লা বিজেপির বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। আবার পায়ের তলায় মাটি শক্ত করতে সেটাই জরুরি তাঁর জন্য।
মায়াবতী, জগনের মতোই দুই শিবিরের কাছেই অচ্ছুৎ ওয়েইসির এআইএমআইএম এবং অসমের এআইইউডিএফ। ওয়েইসি-কে কংগ্রেস-সহ সব বিরোধী দলই বিজেপির বি-টিম বলে থাকে। আবার অসমে এআইইউডিএফকে বিজেপি বলে কংগ্রেসের বি-টিম। বস্তুত এই দলের সঙ্গে জোট করে কংগ্রেস বিগত কয়েকটি নির্বাচনে লড়াই করেছে। কিন্তু বিজেপির মুসলিম তোষণের অভিযোগ খণ্ডন করতে হাত শিবির ওই দলকে এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা এবং একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কথা বলেছিলেন হরিয়ানার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদলের নেতাদের সঙ্গে। তাঁরাও সাড়া দেননি পদ্ম শিবিরের আহ্বানে। আইএনএলডি হরিয়ানায় একটি পৃথক জোট গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে খবর।
পাঞ্জাবে অকালি দল কৃষি আইনের প্রতিবাদে মোদীর মন্ত্রিসভা এবং এনডিএ ছেড়ে যায় ২০২০ সালে। হালে তারা আবার বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। সংসদে বিরোধীদের সঙ্গে সরকার বিরোধিতায় তাদের দেখা যায়নি। নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনেও বিরোধীদের বয়কটের আহ্বান অগ্রাহ্য করে যোগ দেয় তারা। কিন্তু বিজেপির সঙ্গে নতুন করে তৈরি হওয়া বোঝাপড়া ভেঙে যায় গত মাসে পদ্ম শিবির হিন্দু নেতা সুনীল জাখরকে পাঞ্জাবে দলের সভাপতি করায়। অকালিরা বুঝে যায়, বিজেপি হিন্দু ভোটের একীকরণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শিখ ভোটেও ভাগ বসানোর কৌশল নিয়েছে। তাছাড়া অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুরও বিপক্ষে তারা। তাই আপাতত এনডিএ নিয়ে ধীরে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অকালি নেতৃত্ব।
Leave a Reply